আমার জীবনে সব সিদ্ধান্ত হুট করে নেয়া । আমার কাছের বেশির ভাগ বন্ধু এই কথাটা জানে । এবং এর জন্য প্রায় কাছের কয়েকজন আমাকে ভয় পায় কখন কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ওদের বিপদে ফেলি তা নিয়ে । আর সেটা আবারো প্রমাণিত হল ঢাকের মেলা যাবার সিদ্ধান্ত নেবার পর । বাসা থেকে বেরনোর সময় কোন মেলা-টেলা যাবো ভেবে বেরইনি তাই টাকা ছাড়াই বের হলাম । একটু ঘুরেই ফিরে আসবো । কিন্তু এই একটু ঘুরতে যাওয়া আমাকে যে এতদূর এতকিছুতে নিয়ে যাবে ভাবিনি ।
বিকেলের দিকে শুভ আমার বাসায় এল । চেয়ে দেখলাম ওর মুখে ঈদ মোবারক ঈদ মোবারক ভাব । পারলে কোলাকুলি করে অবস্থা । কাহিনী কি এত খুশি কেন । বলল ঢাকার ভাল একটা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাইছে । শুনে খুশি হবার পরই মুখ কালো করলাম কারণ মা পাশের ঘর থেকে খোটা দেয়া শুরু করল । নাহ এভাবে থাকা যায় না ।
বাইরে বের হলাম । হাঁটতে হাঁটতে বলল ওই মেলায় যাবে,এই কাছেই মেলা, যাবো নাকি। আমার মন খারাপ, বললাম যাবো না। বাসা থেকে টাকা আনিনি পকেট পুরো ফাঁকা আর মেলায় যাবারো মুড নাই। এসময় সোহেল সাইকেল নিয়ে এল।
হুট করে সিদ্ধান্ত নেয়া স্বভাব হিসেবে সিদ্ধান্ত নিলাম যাবো। এইখানেইতো যাই ঘুরে আসি।
রওনা দিলাম। সাইকেল একটা আর চড়ে বসলাম তিনজন। আমি, শুভ, সোহেল।যেতে যেতে নদীর ঘাটে এলাম।আমি জানতাম নদী পার হতে হবে না। কিন্তু সোহেল বলল নদীর ও পাশেই মেলা, পার হলেই হয়। পকেটে টাকা নাই অথচ পার হতে হবে। পার হতে হবে জানলে সত্যিই আসতাম না । সামনে নৌকা, ঘাটের টাকা সব মিলে দরকার ৪০ টাকা। কিছু দুই নম্বরী করতে হবে।কিন্তু আমি করব না বললাম।শুভ তার বীরত্বগাথা অনেক দু নম্বরী ঘটনা শুনিয়ে দু নম্বরীকে এডভেন্চারে পাল্টে দিল। মনে মনে ভাবলাম মাঝে মাঝে করা যায়।এবং সব শেষে মোট পার হলাম, খরচ হল দশ টাকা।
নদীর ওপারে গিয়ে দেখি ঘাট চেন্জ হইছে। নতুন রাস্তা কিছুই চিনি না। সামনে দুই দিকে দুটি রাস্তা গেছে। কেউ বলে এটা ঠিক, কেউ বলে ওটা।একজন কে জিজ্ঞেস করলাম মেলায় যাবার রাস্তা কোনটা। দেখিয়ে দিল আর বলল পাঁচ মিনিট গেলেই পাওয়া যাবে।
মাটির রাস্তা আর রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। তাই হেটে যেতে হল। হাটছি তো হাটছি। বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে কখনও কারবো বাড়ির উঠোন দিয়ে । রাস্তা একবার এদিকে মোড় নেয় আর এক বার অন্য দিকে। আমাদের সাথে ইন্ডিয়া থেকে চোরাই ভাবে আনা সাইকেলের দালালও আছে।তিনি চারটা সাইকেল নিয়ে আসছে। তিনি ঠিক রাস্তায় যেতে কিছুটা হেল্প করলেন।
অবশেষে একটা মোড়ের কাছে এসে কিছু লোক পেলাম। তাদের মেলার কথা বললাম। বলল পার করে আসছি। আবার ফিরে গিয়ে একটু দূরে ওদের কথা মত একটা রাস্তা পেলাম। সেখান দিয়ে আসার পর দেখলাম ধানের জমিতে চলে এসেছি। ঐ দুরে মেলার লাইট বিন্দু আকারে দেখা যাচ্ছে। অথচ কোন রাস্তা নেই। জমির মাঝে আইল আছে কিন্তু কোনটা ঘুরে কোন দিকে গেছে বোঝার উপায় নেই।
আকাশ পরিস্কার। বিশাল চাঁদ উপরে । তার আলো সব দিকে ছড়ানো। আমরা সব দিকেই দেখলাম কিন্তু আন্দাজ করা গেল না আসল রাস্তা কোনটা।
সোহেল আমি ভাবনায় ব্যস্ত কিন্তু শুভ ফোন নিয়ে আছে তেনার জি এফ এর সাথে চ্যাটিং এ। পুরো রাস্তা এভাবেই এসেছে। আমি, সোহেল দুজনে ভেবেচিন্তে এক দিকে এগুতে লাগলাম। শুভর চিন্তা নেই আমাদের পিছু পিছু আসছে। সব চিন্তা আমাদের।
হাটতে হাটতে সোহেল বলল দেখ সামনে আবার পুকুর পড়ে নাকি। আমি পাত্তা দিলাম না। হাটছি আর ঠিক করছি আর কোন দিকে যাবো।ফিরে যাবারও বুদ্ধি নাই কারণ কোন দিক দিয়ে আসছি সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। সব দিকে একই রকম। যেতে যেতে সোহেলের কথা সত্যি করতে পুকুর এসে হাজির হল। একপাশে ক্ষেত আর এক পাশে বাঁশঝাড় আর মাঝখানে বড় পুকুর। পুকুরে নেমে গেলে সবচেয়ে ভাল হয়। ঠিক হল সাইড দিয়ে হাটু পানিতে পানিতে পেরিয়ে যাবো। নামার পর বুঝলাম অসম্ভব। খুব ধান্ডা। উঠে বাঁশঝাড় ভেঙে এগুতে লাগলাম। সাইকেল থাকায় খুব অসুবিধা হল।
পাঁচ মিনিটের রাস্তা। এক ঘন্টা পেরিয়েছে। তারকিছু দুর যাবার পর মেলায় পৌছুলাম।
অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। পৌছে দেখলাম মেলা শেষ। সেদিন ছিল শেষ দিন। দোকান পাট তুলে সব প্যাক করছে সবাই। কয়েকটা জিলাপির দোকান শুধু আছে। তার মাঝে একটা শুভর বন্ধুর। সেই দোকানে গিয়ে ফ্রি জিলাপি, খুরমা পেট ভরে খাওয়া হল।তারপর চলল আড্ডা।
সেখানে একটা টাওয়ারের মত দেখলাম। টাওয়ারটা শলা দিয়ে বানানো। তাকে চারদিক থেকে টানছে বারটা বড় বড় ঘোড়া। দেখার মত জিনিস। ফোনে ফ্লাশ নাই তবুও চেষ্টা করলাম ছবি তুলতে। কিন্তু অন্ধকার ছাড়া কিছুই এল না।
এবার ফেরার পালা । এবার অন্য রাস্তায়। মেলার লোকেরা এই রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। হাটছি। শুভ সেই ফোন নিয়ে গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে মেসেজিংএ । আমি, সোহেল গল্প করে মজা করে যাচ্ছি। যেতে আবার ঝামেলা। সামনে রাস্তা দু দিকে চলে গেছে। শুভ এবার প্রথম ফোন থেকে মাথা তুলে কি কি যেন হিসেব করল। বাম ডান উত্তর দক্ষিণ সব এক করে ডানের রাস্তায় যেতে হবে বলল। আমরা যাব এমন সময় এক লোককে পাওয়া গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি বামের রাস্তাটায় যেতে বললেন। বুঝলাম শুভর ফোনে থাকাই ভাল, গার্লফ্রেন্ড থাকলে মাথা ঠিক না থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের গার্লফ্রেন্ড নাই তাই আমাদের মাথা ফ্রেশ।আমারা হাটা শুরু করলাম।
কিছুদুর যাবার নদীর পাড়ে এলাম। উপরে বিশাল জোছনা ভরা আকাশ নীচে একপাশে নদী অন্য পাশে আখ ক্ষেত মাঝে বালুচর তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি। আমার মাথায় কুমতলব আসলো আখ চুরি করলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। শুভকে পাহারা রেখে আখক্ষেতে ঢুকে গেলাম। পাশেই বাড়ি ঘর। বাচ্চার কথা বলার শব্দ আসছে। খুব সাবধানে ভাঙা শুরু করলাম। এসময় দেখি কিছু লোক এদিকে কাছাকাছি এসে গেছে। পাহারাদার শুভর দিকে তাকালাম তিনি ফোন নিয়ে বিজি। বিপদ অনুভব করে আখখেতে শুয়ে পড়লাম। চলে যাবার পর উঠে আবার ভাঙা শুরু করলাম। এভাবে আট নটা আখ হল। বাজারে যার দাম আশি টাকা। আসা যাওয়ার পয়সা উসুল।
আখ সাইকেলে বেধে রেখে শুভকে ধরতে দিয়ে নদীতে হাত ধুতে গেলাম ।
হাত ধুয়ে এসে শুভ ঝাড়ি শুরু করল সাইকেল ধরে নাকি জি এফ কে এসএমএস দিতে খুব অসুবিধা হইছে। ওর হাত থেকে আমি সাইকেল নিয়ে এগুতে লাগলাম। ওর গার্লফ্রেন্ড নিয়ে প্যানপ্যানানির চেয়ে বালু দিয়ে সাইকেল টানা সহজ।
রাত দশটা পার হয়েছে তখন। হঠাত শুভর ফোনে ওর গার্লফ্রেন্ডের ফোন এল। ফোন দেয়ার কারণ চান্স পাওয়ায় ঢাকার কোন মেয়ে নাকি ওকে ফোন দিছে। কে দিছে, কেন দিছে তা নিয়ে ঝগড়া। আমি শুভকে বললাম "কুল ম্যান কুল"। আমার পাশ থেকে সরে দুরে গেল ঝগড়া করতে। আমি তা দেখে দরাজ গলায় বেসুরো গান ধরলাম। গান শুনে আরও দুরে গিয়ে ঝগড়া চালাতে লাগল।
নৌকা দিয়ে আবারো দু নম্বরী করে দশ টাকায় পার হলাম। রাত হওয়ায় যেখানে কম করেও ষাট টাকা যেত। এবং পরে রাস্তায় উঠে আখ ভাগ করে নিয়ে বাসায় চলে এলাম।তখনও ফোনে শুভর ঝগড়া চলছে।
তবে শুভ খুব ঝামেলা করলেও সব টাকা ওই দিছে। শুভ আসলেই ভাল ছেলে। এভাবে শেষ হল বিনা খরচে ঢাকের মেলা ভ্রমণ।
Comments
Post a Comment