Skip to main content

উপমাবিহীন গল্প (মোজাহিদুল ইসলাম পলাশ )

স্যার আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন "এই খাতাটা তোর? "

পেছনে ইউনিভার্সিটি খাতার সবুজ মলাট। অতএব আমার খাতা। যা ভেবেছিলাম তাই সাদেক, বজলু, আশরাফুল, লিমা সহ ক্লাশের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। ভেবেছিলাম প্রতিবারের মত এবারও হয়ত কোনরকম বেঁচে যাব কিন্তু হল না। ক্লাশ পরীক্ষায় সব থেকে কম নম্বর পেয়েছি তাই সবার শেষে আমার খাতাটা স্যার হাতে নিয়েছেন।

স্যারকে কিছু না বলে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা হেট করে রাখলাম।
স্যার হুংকার দিয়ে উঠলেন, কিরে গাঁধার বাচ্চা কথা বলিস না কেন?, খাতাটা তোর না?
আমি আরো একটু মাথাটা নামানোর চেষ্টা করলাম। কাজ হল না। সর্বোচ্চ মাথা হেট হয়েছে,আমার থুতনি জামার সাথে লেপ্টে আছে আর নিচে নামবে না। ইস আর কতক্ষণ আছে ক্লাশের, ঘন্টা পড়ে না কেন!

ওই গাঁধার বাচ্চা মাথা তোল। বিশের মধ্যে তিন! ক্লাশ ওয়ানের বাচ্চাও তো পরীক্ষা দিলে পাঁচ-ছয় পাইতো। ক্লাশ ফোরে উঠছিস কিভাবে! লজ্জা করে না মানুষকে ক্লাশ ফোরে পড়ি বলতে। আমিতো জীবনে অনেক গাঁধা দেখছি, পড়াইছি কিন্তু তোদের মত এত বড় গাঁধা এই প্রথম।

স্যার খাতাটা বাইরে ছুড়ে মারলেন। ক্লাশ পুরোপুরি নীরব, ইংরেজিতে যাকে বলে পিনপতন নীরবতা।

ঠিক এমন সময় স্কুলের মাঝে সাদা রঙের একটা গাড়ি ঢুকল। এই গরীবদের প্রাইমারী স্কুলে এমন গাড়ি খুব সহজে ঢোকে না। সবাই জানালা দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করছে। কে আসল তা দেখতে স্যারও উঠে ক্লাশের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি মাথা তুলে দেখবো কি দেখবো না করছি এমন সময় বজলু প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠল এই রাতুল তোর বাবা। আমার বাবা! এই স্কুলে! কিভাবে! সবাই এবার গাড়ির দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকালো।

আমি উঠে গিয়ে জানালার কাছে গেলাম। স্যার আমাকে দেখলেন কিছু বললেন না।

আমার বাবা। যাকে দেখার সুযোগ এই হাতে গোনা কয়েকবার হয়েছে। যে কয়বার হয়েছে অনেকটা ছোট্ট টিভির সাক্ষাৎকারের মত। যেমন ধরুন বাবার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। আমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন কেমন আছি? কোন ক্লাশে পড়ি (বাবা সত্যিই জানেন না আমি কোন ক্লাশে পড়ি তাই প্রতিবার দেখা হবার পর এই বাবা-ছেলের সম্পর্কে এই অদ্ভূত প্রশ্নটা চলে আসে), কোন অসুবিধা আছে কিনা? দোকানের কোন জিনিসটা খেতে ইচ্ছে করে? এটুকুই। হ্যা এটুকুই। আমি এখানেও মাথা হেট করে উত্তর দেই। তারপর প্রাণ ম্যাংগ জুস বা কোকাকোলার একটা বোতল ধরিয়ে দিয়ে বলে বাড়ি যাও। আমার বাবা আমাকে কোন দিন কোলে নিয়েছিল এমন কোন স্মৃতি নেই। নিয়েছিল বোধহয়।

তবে এখানে কোন দুঃখ লাগে টাগে না। দুঃখ তখন লাগে যখন না পাওয়া থাকে। বাবা না থাকা ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এমনকি অামি অনেকের কাছে ঈর্ষার পাত্র। বজলুর বাবা বজলুকে সপ্তাহে রুটিন মাফিক পিটুনি দেয়। আশরাফুলের বাবা আরও এককাঠি সরেষ। তিনি শুধু পিটুরিই দেন না, পিটুনির পাশাপাশি প্রতিবারই আশরাফুলকে শুকরের বাচ্চা বলে অতি নিষ্ঠুরভাবে বাড়ি থেকে বের করে দেন। আশরাফুলের মা আবার ছেলেকে খুজেটুজে বাসায় নিয়ে আসেন। এখন সেদিক থেকে আমার বাবাই নেই পিটুনি দেয়া বা বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ব্যাপারগুলো আমার কাছে রূপকথার গল্প শোনার মত। যার মাথা নেই তার মাথা ব্যাথার প্রশ্নই আসে না। মা মাঝে মাঝে রাগ হয় কিন্তু কখনও মারেন নাই। তাই বজলু আর আশরাফুল পিটুনি খেলে তারা সব রাগ আমার উপর ঝাড়ে। বজলু মার খেলে তার মুখের ব্যালেন্স ঠিক থাকে না। আমাদের সামনে সে তার বাবাকে জানা অজানা প্রায় সব রকম ভাষাতেই গালিগালাজ করে। তার বাবার সামনে অবশ্য সে পুশি বিড়ালের মত লেজ গুটিয়ে নেয়।

বজলু যা করে তা আসলে আশরাফুল করলে তাও মানাতো কিন্তু বজলু যেন বজলুই। বাবার উদ্দেশ্যে বজলুর শেষবারের গালিগালাজ ছিল এমন, শালা, সন অফ বিচ (বজলুর কোন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা ইংলিশ গালি), খালি বড় হইতে দে, শালার যদি চোখ না উপড়াইছি আমার বাপের নাম পাল্টায় রাখিস। আমি টিভি দেখলাম আধা ঘন্টা আর শালায় কয় তিন চার ঘন্টা। সন অফ বিচ, বিচের বাচ্চা.......

তবে জিনিস কেনা থেকে শুরু করে, ঘুরতে যাওয়া এমন অনেক কাজ আছে যেগুলোতে বাবার দরকার। মা কোথাও ঘুরতে যান না। খেলনা বা বল ব্যাট কিনে দেয়ার মত টাকা মায়ের কাছে নেই। প্রথম দিকে ঘ্যানঘ্যান করতাম। এখন আর চাই না। মা নানীর বাসায় থাকেন। বড় মামা কিছু টাকা পাঠান সেই টাকায় চলে সংসার। ছোটতে নানী বলতেন আমার বাবা বিদেশে থাকে। মা কখনও কিছু বলতেন না। চুপ করে থাকতেন। এই ক্লাশ থ্রীতে ওঠার পর একদিন আমার মামাতো বোনের কাছে সব জানতে পারি।

আমার মা বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ আমার আরেক জন মা আছে। সৎ মা। স্টেভ মাদার। বাবা সেই পক্ষতে থাকেন। সেই মায়ের এক ছেলে এক মেয়ে। সেখানেই তার সংসার।

সেই ছেলে আর মেয়েটাকে নিয়ে ঘুরতে যান, সেই ছেলে আর মেয়েটাকে খেলনা জামা কাপড় কিনে দেন, হয়ত সেই ছেলে আর মেয়েটাকে কোনকোনদিন পিটুনিটাও দেন দোষ করলে। আবার আদরও করেন। বাবার আদর। আমি বাবার পিটুনি যেমন খাইনি তেমনি "বাবার আদর" বলে যে জিনিস টা আছে সেটাও পাইনি।

প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সাথে বাবার বিয়েটা হয় গোপণে। ইটিস পিটিস প্রেম, অতঃপর গোপণে বিয়ে। এদিকে ফ্যামিলী থেকে জোর করে নাকি বাবার বিয়ে দেয় আমার মায়ের সাথে। বিয়ের পর ছয় সাত মাস সংসার করে বাবা। আমি পেটে আসি। তখন একদিন হঠাৎ সেই সৎ মা চলে আসে আমার বাবা মায়ের সুখের (সম্ভবত) সংসারে। তারপর আমার জন্মের আগে পর্যন্ত একই বাড়িতে থাকে। আমার মা আমার জন্মের এক মাস আগে এখানে অর্থাৎ নানীর বাসায় থাকা শুরু করে। আমার জন্মের পর আমাকে নিয়ে যখন ফিরে যায় তখন আর সেই বাসায়, তার নিজের স্বামীর বাসায় ঢুকতে পারে না। ঢুকতে দেয় না। নানীর বাসায় ফিরে আসে তারপর। তালাক হয়ে যায়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এভাবেই চলছে। মা আর বিয়ে করেননি। বাবা তারপর ভাল চাকরি পেয়ে ঢাকায় বৌবাচ্চা সহ (!) চলে যায়। আমাদের পাশের গ্রামে বাবার বাড়ি ওহ না ওটা হবে আমার দাদু বাড়ি। সেখানে ঘুরতে এলে হঠাৎ আমার সাথে মাঝেমাঝে দেখা হয়ে যায়।

তবে এভাবে আজ আমার স্কুলে গাড়ি নিয়ে আসার কারণ বুঝলাম না। স্যার আমাকে বললেন, যাও তোমার বাবার সাথে দেখা করে আসো। এতক্ষণ স্যার তুই তুকারি করছিলেন। এখন তুই থেকে তুমি। বাবা থাকলে হয়ত এমন আরও অনেক পরিবর্তন আসতো জীবনে।
আমি ক্লাশ রুম থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। সাদা ধবধবে গাড়ি। বাবা আমাদের পাশে থাকলে এই গাড়িটায় আমি নিজেই চড়ে ঘুরতাম।

বাবা হেড স্যারের রুমে। আমি হাঁটতে হাঁটতে হেড স্যারের রুমেরর দরজার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবা আর হেড স্যার তুই তুকারি করে কথা বলছেন। হেড স্যার যে বাবার পুরনো দিনের বন্ধু আজ প্রথম জানলাম। তাদের কথাবাত্রা শুনে বুঝলাম বাবার বাসার কাজের মেয়ের জন্য স্কুল থেকে ক্লাশ টুয়ের বই নিতে এসেছেন। আমার জন্য আসেনি!

ক্লাশে গিয়ে বসলাম।স্যার পড়াচ্ছিলেন। আমাকে দেখে স্যার বললেন, কথা হল?

আমি কি উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। মিথ্যে বলব যে হ্যা কথা হল! নাকি সত্যিটা বলব যে না কথা হয়নি, বাবা আমার জন্য আসেননি, এসেছেন তার বাসার কাজের মেয়েটার জন্য বই নিতে। আমি জানি পৃথিবী আমার কথা বুঝবে না। বুঝবে না কোন উপমা বিহীন গল্পের চরিত্রগুলোকে। কোন চরিত্রই যে সবার দেখা চরিত্র নয়। কার সাথে তুলনা দেব, কার সাথে মিলিয়ে উপমা তৈরি করব।

মোটামুটি হাসি হাসি মুখ করে স্যরের উত্তর এড়িয়ে গেলাম। স্যার আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে ক্লাশ থেকে চলে গেলেন। ক্লাশের সময় শেষ। এরপর ইংরেজি, কাদের স্যারের ক্লাশ। সবাই তাদের হোম ওয়ার্ক বের করে ক্যাপ্টেন সাদিককে জমা দিচ্ছে। আমার মনে পড়ল আমি হোম করতে ভুলে গেছি! এই ক্লাশেও তাহলে উত্তম মাধ্যমের ব্যবস্থা হচ্ছে আমার জন্য। এমন সময় দপ্তরী এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আমার নাম ধরে ডাকতে লাগল। আমি সামনে গেলে বলল হেডস্যার আমাকে ডাকে।

হেডস্যারের রুমে গেলাম। হেডস্যার বললেন স্কুল গেটের কাছে যেতে সেখানে নাকি বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য।

স্কুল গেট পেরিয়ে একটু দূরে সাদা গাড়িটা দাঁড় করানো। বাবা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন আর এদিক ওদিক দেখছেন। আমি যাবার সাথেই খানিকটা হাসিহাসি মুখে আমাকে পাশে দাঁড় করালেন। তারপর বললেন....

কেমন আছো রাতুল?

হুম ভাল।

এখন কোন ক্লাশে পড়ো?

ক্লাশ ফোরে।

কোন অসুবিধা আছে কিনা?

না।

দোকানের কোন জিনিসটা খেতে ইচ্ছে করে?

না।

ঠিক আছে গিয়ে ভাল করে পড়াশুনা কর। তুমি এই স্কুলে পড় জানতাম না।

ও।

Comments

Popular posts from this blog

Abar ( আবার ) Lyrics - Minar Rahman

Abar ( আবার ) Lyrics - Minar Rahman তুমি কি আমার হাসি মুখের আবার কারন হবে ?  তুমি কি আমার শত ভুলের আবার বাড়ন হবে ? দেবো না জল আসতে চোখে ,  কোনদিনও আর ,  আর একটি বার দাও যদি জল মোছার অধিকার । তুমি কি আমার হাসি মুখের আবার কারন হবে?  তুমি কি আমার শত ভুলের আবার বাড়ন হবে ?  আমি তোমার নতুন ভোরের সূর্য হতে চাই ,  আমি আবার তোমার আসার প্রদীপ হতে চাই ।  দেবো না জল আসতে চোখে,  কোনদিনও আর,  আর একটি বার দাও যদি জল মোছার অধিকার ।  তুমি কি আমার হাসি মুখের আবার কারন হবে?  তুমি কি আমার শত ভুলের আবার বাড়ন হবে?  মুছে ফেলো অভিমানের দাগটি তুমি এবার,  হাসির আলো,  আমায় করো আলোকিত আবার । দেবো না জল আসতে চোখে,  কোনদিনও আর,  আর একটি বার দাও যদি জল মোছার অধিকার।  তুমি কি আমার হাসি সুখের আবার কারন হবে?  তুমি কি আমার শত ভুলের আবার বাড়ন হবে? Song: Abar Singer: Minar Lyrics: Snahashish Ghosh Music: Rezwan Sheikh Cast: Siam & Saira DOP: Suman Sarker Direction: Mahmudur Rahman Hime Asst director team: Emran Robin, Dipto...

Bangladeshi Movie Download Sites (বাংলাদেশী মুভি ডাউনলোড)

NEXTGEN BD - http://180.200.238.22/ Orangebd- orangebd home bd http://103.3.226.206/ Bangla Movie Download Sites new bangla movie Bangladeshi movies

এই. রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা Lyrics [Bangla] | ai rasta gulo lage | দেবী (debi) by ADNAN ASHIF | bangla new song 2018

এই. রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা. আকাশটার সাথে নাই জানাশোনা... এই. রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা. আকাশটার সাথে নাই জানাশোনা... আমি তোর. প্রেমেতে অন্ধ  ছিলো চোখ কান সব বন্ধ..... থেমে গেছে জীবনের লেনাদেনা...................... সেই পুরোনো রাস্তাটায়.  আজ একা একা হেটে  যাই  হচ্ছনা হিসাবের বনিবনা...  এখন এমনি করে  ভালো  কেমন করে বাসি অন্য কোনো পাখিকে ।।।।। তার চেয়ে ভালো ছিল তুই নিজ হাতে খুন করে.. যেতি,,,,  আমাকে......... এই দুপুর রোদের ভিড়ে  একটু খিদে পেলে  তোর  নাম্বারটায় ফোনতো আর ঢোকেনা...  তুই তো জানিস  ঠিক  তুই ছাড়া আমার  মুখের অমৃতটাও একা  রোচেনা.....  মাঝরাতে তোর SMS er Tone  আমার গভীর  ঘুম টাকে আর ভাঙ্গায় না ব্যস্ত নগড়ে  আমার বুকের গভীরে  তোর মাথা রাখা মনটাকে রাঙ্গায় না,,,,,  এখন এমনি শত যন্ত্রনা  কেমনি করে বলি  অন্য কোনো সাথীকে,,,,,  তার চেয়ে ভালো ছিল তুই নিজ হাতে খুন করে.. যেতি,,,,  কতনা ভাল হত তু্ই আসতি যদি ফিরে স্বপ্ন দিয়...