তখন বয়স কত হবে ঠিক মনে নেই। আট নয় বছর হতে পারে। সে সময় আমি আর মা ভাড়া বাড়িতে থাকি।
আমার একটা ছোট বাচ্চাদের রিকসা ছিল । তখন রিকসা চালানোর বয়স শেষ, তবু যক্ষের ধনের মত রিকসা আগলে রাখি। কেউ চালালে হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাই। সাথে সাথে তাকে নামিয়ে রিকসায় উঠে বসে থাকি। চালাতে গেলে হাটু হ্যান্ডেলে লাগে,দেখতে বেখাপ্পা লাগে, তবু বসে থাকি।
ঘটনা ঘটল যেদিন বাড়ি ওয়ালার নাতনি আমার স্থাবর সম্পত্তি রিকসাটা নিয়ে টানাটানি শুরু করল। নাতনির বয়স হবে চার বা পাঁচ বছর। আমি ক্রিকেট বাইরে খেলতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা নামলে বাসায় ফিরে দেখি আমার রিকসা নিয়ে তাতে বসে আছে মেয়েটা। মাথায় শর্ট সার্কিট হয়ে গেল। রিকসা থেকে ওকে নামতে বলি, মেয়ে নামে না। উল্টা ঘড়ঘড় শব্দ করে ওদের বারান্দায় চালাতে লাগল। সহ্য ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেল। আমি পাজকোলা করে ধরে জোর করে রিকসায় নামিয়ে রিকসা দখল করলাম।
ঠিক তখন বোমা ফাটার শব্দের মত শব্দ করে মেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। আমি ভ্রুক্ষেপ না করে ঘড়ঘড় শব্দ করে ওর নাকের সামনে দিয়ে রিকসা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আহা কি শান্তি!
ঠিক তখন বাড়ি ওয়ালী যাকে আমিও নানী বলে ডাকি তিনি তার নাতনির কান্না শুনে তেড়েফুঁড়ে চলে এলেন। আসার পর নাতনীর কান্না থামাতে আমাকে দিলেন রাম ঝাড়ি। এমনও বললেন যে তাদের বাসায় থেকে এমন করার সাহস পাই কিভাবে!
আমার ছোট্ট ইগোতে লেগে গেল কথাটা। আসলেইতো আমি তাদের বাড়িতে থাকি! আমার কোন বাড়ি নাই!!!
মা সে সময় বাজারে ছিল। আমি ঠিক করলাম এ বাড়িতে আর থাকবো না। গৃহ ত্যাগী হব। এত বড় অপমান মাথায় নিয়ে এ বাড়িতে থাকার কোন মানে হয় না।
অবশেষে রিকসাটা ঘরের মাঝে রেখে আমার ছোট্ট সাইকেল নিয়ে রাত আটটায় বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। দু চোখ যেদিকে যায় সেদিকে যাবো টাইপ চিন্তা ভাবনা করে বাসা থেকে বের হলেও বের হবার পর বুঝলাম কাজটা অতটা সোজা না। কোথায় যাওয়া যায়? কোথায় যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে অবশেষে বুঝলাম আমার আসলে গৃহত্যাগী হয়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এদিকে বাসাতে ফিরবোই না বলে ঠিক করে বেরিয়েছি মানে ফিরবোই না। অবশেষে গেলাম আমাদের বাসায় যে মহিলা কাজ করে তার বাসায়। তারা সাদরে গ্রহণ করল আমাকে। আমি আশ্রয় পেয়ে গেলাম। তার মেয়ের জামাই রিকসা চালায়। আমি ঠিক করলাম আমিও রিকসা চালিয়ে টাকা ইনকাম করে হোটেলে খাবো আর থাকব। তবু বাসায় ফিরব না।
কিন্তু এগারটা যখন বাজলো মায়ের জন্য মন খারাপ করা শুরু হল। ঘুম আর ধরে না। এত খারাপ লাগা শুরু হল যে বলার মত না। সেই কাজের মহিলা রাত সাড়ে এগারটার দিকে তার মেয়ে জামাইয়ের দ্বারা আমাকে সাইকেল সমেত বাসায় ফিরিয়ে আনলেন। শেষ হল আমার দু চোখ যে দিকে যায় শিরোনামের এডভেন্চার।
এতবছর পর আমার ছোট ভাই আজ রাতে বাসায় রাগারাগি করে আমার মত গৃহত্যাগী হল। বারো বছর বয়স।সে আমার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। তার স্কুল ব্যাগে কাপড় চোপড়ও নিয়েই গৃহত্যাগী হয়েছে। শীতের রাত। বাইরে ঘন কুয়াশা। সবাই লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। সবার ঘুমের বারটা বাজিয়ে পুরো এলাকা খোজা হল, দোকানে চিপায় চাপায় খোজা হল। মা ওর বন্ধুদের বাসায় গিয়ে খুজল। কোথাও নেই। আম্মুরতো টেনশনে অবস্থা খারাপ।
আমি সোজা সাইকেল চালিয়ে চলে গেলাম সেই কাজের মহিলার বাসায়। আমারই ছোট ভাই, গিয়ে দেখি সেখানেই আছে। কান ধরে বাসায় নিয়ে এলাম।
আসার সময় তাকে আমার ঘর পালানোর গল্পটা বললাম আপনারা যেটা পড়লেন এতক্ষণ। আর নাকি পালাবে না।
Comments
Post a Comment