২০১৪ সালের নভেম্বর মাস। শীতে আর কুয়াশায় ফুলবাড়িতে সবার জড়সড় অবস্থা।
এরকম একটা দিনে আন্তর্জাতিক শিশু চলচিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা জমা দেয়ার তারিখ ঘোষনা করা হল। এখানে সারা দেশ থেকে জমা হওয়া ছোটদের তৈরি শর্টফিল্ম দেখানো হয়। ভেবে রেখেছিলাম এবার একটা শর্টফ্লিম বানিয়ে জমা দেবো। বয়স গুণে দেখি আমার বয়স ঠিক একমাস আগে ১৮ পেরিয়েছে। চেহারায় বুড়ো বুড়ো ভাব চলে এসেছে। আমি শিশু থেকে বড় হয়ে গেছি। সিনেমা জমা দিতে পারব না। :(
.
মন খারাপ করতে যাবো ঠিক এসময় ঘোষণার এক কোণে চোখ আটকে গেল। নতুন একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। সেখানে বুড়োরাও সিনেমা জমা দিতে পারবে। সেটা হতে হবে বাল্য বিবাহ নিয়ে।
যাক সুযোগ পাওয়া গেছে। দুই রাত না ঘুমিয়ে কয়েকটা গল্প লিখে ফেললাম। বন্ধু লিমনকে বাসায় এনে গল্পগুলো পড়তে দিলাম। লিমন "প্রশ্ন" গল্পটা পড়া মাত্র লাফ দিয়ে উঠে বলল " অস্থির! ফাস্ট পুরস্কার পেয়ে গেছি। এত সুন্দর কাহিনী বানাতে পারলে ফাস্ট হবেই। এটা বানাতেই হবে।"
.
আমি ওর লাফানি দেখে শর্টফ্লিম বানানোর আশা ছেড়ে দিলাম। কারণ যে বিষয়ে লিমন লাফায় সেগুলো একটাও আলোর মুখ দেখে না। কেন দেখে না সেটা পরের টুকু পড়লে বুঝবেন। কাহিনীতে ফিরি।
ওকে বললাম বুঝলাম ফাটাফাটি হবে কিন্তু বানাতে হবে তো আগে। ফোন দিয়ে না হয় ভিডিও করা গেল তবু অনেক কাজ বাকি। প্রথমত অভিনয়ে মেয়ে লাগবে। ফুলবাড়িতে আমার পরিচিত কোন মেয়ে নাই যে সে অভিনয়ে রাজি হবে।
তারপর বাবা লাগবে দুজন, মা লাগবে একজন। এই চরিত্রগুলোর অভিনেতা অভিনেত্রী কোথায় পাবো?
লোকেশনও তো একটা ফ্যাক্টর!?
অনেক চিন্তা করে মেয়ে সহ চরিত্রগুলোতে অভিনয়ে নেয়া যাবে এমন নামের লিষ্ট করে ফেলা হল। তাদের নাম প্রকাশ করছি না। প্রথমে গেলাম বাবার চরিত্রে যাকে ঠিক করেছি তার কাছে। তার স্টেজে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের গল্প শোনার পর রাজি হলেন। স্ক্রিপ্ট চাইলেন, ফটোকপি করে দেয়া হল।তিনি তার অভিনয় ক্যারিয়ারের বিস্তর গল্প শোনালেন। এমন ভাল অভিনেতাকে পেয়ে যাবো ভাবিনি। তারমানে আমরা তৈরি করতে যাচ্ছি শর্টফ্লিমটা!
এখন যে মেয়েটাকে নেয়ার চিন্তা করা হয়েছিল তার ওখানে যাবো বলে ঠিক করা হল। আমি মেয়েটার সাথে পরিচিত ছিলাম না তাই বুঝতে পারছিলাম না কেমন হবে।
তাদের বাসায় যাবার পর খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হল। সত্যি বলতে একরকম অপমান হয়ে ফিরতে হয়েছে।
লিমন বলল কোন দরকার নাই বানানোর, ফুলবাড়িতে এসব সম্ভব না।
দুজনেরই মন খারাপ।
তার পরদিন জিয়নের সাথে দেখা। সে বলল তার কাছে ভিডিও ক্যামেরা, ট্রাইপড আছে। আবার আগ্রহ ফিরে এল। শর্টফ্লিম নাহোক ক্যামেরা যখন আছে কিছু না কিছু বানাবো। ক্যামেরা ট্রাইপড নিয়ে আসতে বলে দিলাম।
.
এসময় জিয়ন বলল মিনু আর আশার কথা। আমরা আলোচনা শুরু করলাম। মেয়ে বিষয়ে আগের অভিজ্ঞতা যেহেতু ভাল না তাই অনেক দিক নিয়ে চিন্তা করা হল। দ্বিতীয়বার কারও বাড়িতে বখে যাওয়া ছেলে উপাধি পাবার কোন ইচ্ছা নাই।
শেষে প্লান ঠিক করা হল। প্রথমে গার্জিয়ান পর্যায়ে না গিয়ে তাদের সম্মতি আছে কিনা তা দেখা হবে, তারা রাজি থাকলে তাদের দিয়েই তাদের গার্জিয়ানকে বলানো হবে। গার্জিয়ান রাজি না থাকলে তাদের বাদ দেয়া হবে। আমাদের মাঝখান থেকে কারও কাছে কোন কথা শুনতে হবে না।
মিনু আর আশাকে বলার পর তারা রাজি হল এবং গার্জিয়ান পর্যায়ে সম্মতি পাওয়া গেল।
.
শুটিংয়ের ডেট ঠিক করা হল। জিয়ন শুটিং লোকেশনের ব্যবস্থা করে দিল। ক্যামেরা, ট্রাইপড আনা হল।
.
শুটিং এর দিন সকাল। হঠাৎ লিমনের ফোন। ঠান্ডা গলায় বলল তারপক্ষে কাজ করা সম্ভব না, বাসায় সমস্যা। এই সমস্যার সাথে আমি পরিচিত। কোন কিছু করতে গেলে শুরু হবার পর তার বাসায় সমস্যা হয়। সে থাকে না।
কি আর একাই করব। ঠিক করে রাখা অভিজ্ঞ অভিনেতাকে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। শেষ পর্যন্ত তার কাছে গেলাম। গিয়ে তার ছোট ভাইয়ের সাথে কথা হল। বড় ভাই কোথায় সে কিছুই জানে না। :3
আবার আশা ছেড়ে দিলাম। হবে না। সম্ভব না। কিছুই করার নাই এখন।
সবাইকে জানিয়ে দিলাম শুটিং ফুটিং কিছু হবে না।
ক্যামেরা ট্রাইপড যেহেতু আছে ঠিক করলাম ফুলসাগরের ভিডিও করে নিয়ে আসি। কি আর করা যাবে।
বের হবার সময় ভাবলাম লিমনের সাথে দেখা করে যাই। দেখা করতে গিয়ে লিমনের বাবার সাথে দেখা হল। ওনাকে সব খুলে বললাম। তিনি লিমনকে ছাড়লেন। কেন ছাড়লেন জানি না, কখনও এমন হয় না। ওকে নিয়ে ফুলসাগরের দিকে রওনা দিলাম। ট্রাইপড কাধে নিয়ে হাঁটা শুরু হল।
.
থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছি। কাঁধে ট্রাইপড, হাতে ক্যামেরা। একজন পুলিশ আমাদের থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল, কিসের ক্যামেরা, কিসের শুটিং। তখনও বুঝিনি কি হতে যাচ্ছে। তিনি আমাদের কাহিনী শুনলেন (সম্ভবত একে করুণ বলা উচিত)। তিনি বললেন কোন চিন্তা নেই, তিনি অভিনয় করবেন আমাদের শর্টফিল্মে। ফোন দিয়ে আশা আর মিনুকে ডাকা হল, নোমান (শিশুশিল্পী) কে ডাকা হল। ফিরে আসার সময় রাজু ভাইয়ের সাথে দেখা হল। লিমন কিভাবে যেনো অভিনয়ে তাকে রাজি করিয়ে ফেললো। রাজু ভাই আবার আবার আরও একজন তার পরিচিত মানুষকে রাজি করিয়ে ফেললেন।
.
শুটিং শুরু হল। হ্যা সত্যি সত্যি শুটিং শুরু হল! লিমন গামছা ঘাড়ে নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে, সব ঠিকঠাক করছে। অন্যদিকে আমি অভিনেতাদের ডায়লগ বুঝিয়ে দিচ্ছি, জিয়ন ক্যামেরা ঠিক করছে, নীরব তার নতুন ফোনে আমাদের ছবি তুলছে, আমার ছোট ভাই প্রতীক, তার বন্ধু নুরনবী বাকি নাম না জানাদের দলবল নিয়ে শুটিং দেখতে আসা দর্শকদের ভীড় সামলাচ্ছে, চুপ করাচ্ছে, মুন্না করার মত কাজ না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সার্কাস দেখছে।
সবাই যে যার মত কাজ করে গেলাম।
মাঠে শুটিং হল। আঙ্গিনায় শুটিং হল। ফুলসাগরে হল। বাড়ির বারান্দায় হল। তখন সবাই কাজে ব্যস্ত। কোন অসুবিধাই আর গায়ে লাগল না।
.
সব শুটিং শেষে বাসায় আনার পর দেখা গেল সাউন্ডে গড়বড় হয়ে গেছে। আরও একদিন পুনরায় শুটিং করা হল।
.
এবার এডিটিং এর পালা। এডিটিং করতে গিয়ে বুঝলাম কাজ প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার মত হয়নি। ভিডিওতে আমি নিজেই হাজারটা ভুল বের করছি, প্রতিযোগীতার বিচারকরাতো লাখ খানেক ভুল পেয়ে যাবে। প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার চিন্তা বাদ দিলাম।
.
এডিটিং শেষ হল। তখন ২০১৪ সাল, এখনকার মত আনলিমিটেড নেটের রাজ্যে বাস করি না। তাই শেয়ার ইট আর ব্লুটুথই ভরসা। যারা চাইলো, দিলাম।
.
এবার সবর্শেষ কথায়। তা হল আমি যে একটি শর্টফ্লিম বানিয়ে ফেললাম, তার বিনিময়ে আমি এবং আমার ইউনিটের সবাই কি পেল।
তাদের মাঝে আমি শুধু একবার এক কেজি জিলাপি কিনে দিয়েছিলাম। বিশের উপরে মানুষ ছিল। যে যতটুকু সেদিন খেয়েছিল এটুকুই তাদের সর্বমোট পাওয়া। তাদের ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারিনি। এডিটিং শেষ হতেই কাউকে কিছু না বলে আমি ঢাকা চলে আসি ভার্সিটির ভর্তি কোচিং করতে।
লিমনের কথা বাদ দেই, সে বন্ধু মানুষ।
জিয়ন সম্ভবত শুটিংএই আমার উপর মন খারাপ করেছিল। কেন করেছিল এখনও জানি না।
আশা এবং মিনুর সাথে কয়েকবার ফেসবুকে কথা হয়েছিল। কিন্তু তারা অভিনয়ে রাজি হবার কারণে আমার বা আমাদের যে কি উপকারটা হয়েছিল তা তাদের বলিনি। তারা রাজি না হলে হয়ত এই শর্টফ্লিমটাই হত না। তাদের কোন ভাষায় বোঝাতে পারব না দুজনই কত ইম্পর্টেন্ট ছিল।
সেই পেপার পড়া বাবার চরিত্রের লোকটার সাথে, তার বউয়ের সাথে পরে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। তাদের দোকান বন্ধ ছিল এরপর থেকে। তবে তাদের বাসায় ডিভিডি পৌছে দেয়া হয়েছে।
সেই পুলিশ ভাই আমার বাসা পর্যন্ত এসেও তার অভিনয় দেখতে পারেননি। আমি যখন ফুলবাড়ি এসে ওনার খোজ নেই তখন শুনি উনি বদলি হয়ে চলে গেছেন। হয়ত এতদিন পরও ওনার এত ভাল অভিনয় করা শর্টফ্লিমটা দেখতে পারেননি।
আর আমি। আমি কি পেয়েছি? সত্যি বলতে স্বার্থপরের মত যা লাভ সবটুকুই আমি পেয়েছি।
সবাই এই শর্টফ্লিমকে আমার শর্টফ্লিম হিসেবে জানে। হ্যা, কোন টাকা পয়সা পাইনি কিন্তু ক্রেডিটতো দেয় আমাকে। কেউ কোন অভিনেতা বা আর কে আছে এর পেঠনে এগুলোর খোজ করে না।
আমাকে দেয়া প্রতিটা ক্রেডিট আমার গায়ে লাগত। এজন্য আমি একরকম লজ্জাতেই আমার জীবনের এই অংশটুকু দুই বছরের কাছাকাছি লুকিয়ে রেখেছিলাম।
.
কিছুদিন আগে মিনু আমার কাছে ভিডিওটা অনলাইনে চাইল। আপলোড দিতে গিয়ে মনে পড়ল সবকথা। তখনই প্লান করলাম কি কি করব। এটা সেই প্লানের শেষ অংশ।
আমি সবার কাছে আমার স্বার্থপরতার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। সত্যিকারের ক্ষমা। কিছুতো দিতে দিতে পারিনি, বিনা খরচায় দিতে পারা ধন্যবাদটা আজ দেই। অসংখ্য, অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে এই শর্টফ্লিমটায় কাজ করার জন্য।
এবং আপনি পড়ছেন, আপনাকেও ধন্যবাদ এতদূর পড়ার জন্য। সবাই ভাল থাকবেন।
এরকম একটা দিনে আন্তর্জাতিক শিশু চলচিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা জমা দেয়ার তারিখ ঘোষনা করা হল। এখানে সারা দেশ থেকে জমা হওয়া ছোটদের তৈরি শর্টফিল্ম দেখানো হয়। ভেবে রেখেছিলাম এবার একটা শর্টফ্লিম বানিয়ে জমা দেবো। বয়স গুণে দেখি আমার বয়স ঠিক একমাস আগে ১৮ পেরিয়েছে। চেহারায় বুড়ো বুড়ো ভাব চলে এসেছে। আমি শিশু থেকে বড় হয়ে গেছি। সিনেমা জমা দিতে পারব না। :(
.
মন খারাপ করতে যাবো ঠিক এসময় ঘোষণার এক কোণে চোখ আটকে গেল। নতুন একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। সেখানে বুড়োরাও সিনেমা জমা দিতে পারবে। সেটা হতে হবে বাল্য বিবাহ নিয়ে।
যাক সুযোগ পাওয়া গেছে। দুই রাত না ঘুমিয়ে কয়েকটা গল্প লিখে ফেললাম। বন্ধু লিমনকে বাসায় এনে গল্পগুলো পড়তে দিলাম। লিমন "প্রশ্ন" গল্পটা পড়া মাত্র লাফ দিয়ে উঠে বলল " অস্থির! ফাস্ট পুরস্কার পেয়ে গেছি। এত সুন্দর কাহিনী বানাতে পারলে ফাস্ট হবেই। এটা বানাতেই হবে।"
.
আমি ওর লাফানি দেখে শর্টফ্লিম বানানোর আশা ছেড়ে দিলাম। কারণ যে বিষয়ে লিমন লাফায় সেগুলো একটাও আলোর মুখ দেখে না। কেন দেখে না সেটা পরের টুকু পড়লে বুঝবেন। কাহিনীতে ফিরি।
ওকে বললাম বুঝলাম ফাটাফাটি হবে কিন্তু বানাতে হবে তো আগে। ফোন দিয়ে না হয় ভিডিও করা গেল তবু অনেক কাজ বাকি। প্রথমত অভিনয়ে মেয়ে লাগবে। ফুলবাড়িতে আমার পরিচিত কোন মেয়ে নাই যে সে অভিনয়ে রাজি হবে।
তারপর বাবা লাগবে দুজন, মা লাগবে একজন। এই চরিত্রগুলোর অভিনেতা অভিনেত্রী কোথায় পাবো?
লোকেশনও তো একটা ফ্যাক্টর!?
অনেক চিন্তা করে মেয়ে সহ চরিত্রগুলোতে অভিনয়ে নেয়া যাবে এমন নামের লিষ্ট করে ফেলা হল। তাদের নাম প্রকাশ করছি না। প্রথমে গেলাম বাবার চরিত্রে যাকে ঠিক করেছি তার কাছে। তার স্টেজে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের গল্প শোনার পর রাজি হলেন। স্ক্রিপ্ট চাইলেন, ফটোকপি করে দেয়া হল।তিনি তার অভিনয় ক্যারিয়ারের বিস্তর গল্প শোনালেন। এমন ভাল অভিনেতাকে পেয়ে যাবো ভাবিনি। তারমানে আমরা তৈরি করতে যাচ্ছি শর্টফ্লিমটা!
এখন যে মেয়েটাকে নেয়ার চিন্তা করা হয়েছিল তার ওখানে যাবো বলে ঠিক করা হল। আমি মেয়েটার সাথে পরিচিত ছিলাম না তাই বুঝতে পারছিলাম না কেমন হবে।
তাদের বাসায় যাবার পর খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হল। সত্যি বলতে একরকম অপমান হয়ে ফিরতে হয়েছে।
লিমন বলল কোন দরকার নাই বানানোর, ফুলবাড়িতে এসব সম্ভব না।
দুজনেরই মন খারাপ।
তার পরদিন জিয়নের সাথে দেখা। সে বলল তার কাছে ভিডিও ক্যামেরা, ট্রাইপড আছে। আবার আগ্রহ ফিরে এল। শর্টফ্লিম নাহোক ক্যামেরা যখন আছে কিছু না কিছু বানাবো। ক্যামেরা ট্রাইপড নিয়ে আসতে বলে দিলাম।
.
এসময় জিয়ন বলল মিনু আর আশার কথা। আমরা আলোচনা শুরু করলাম। মেয়ে বিষয়ে আগের অভিজ্ঞতা যেহেতু ভাল না তাই অনেক দিক নিয়ে চিন্তা করা হল। দ্বিতীয়বার কারও বাড়িতে বখে যাওয়া ছেলে উপাধি পাবার কোন ইচ্ছা নাই।
শেষে প্লান ঠিক করা হল। প্রথমে গার্জিয়ান পর্যায়ে না গিয়ে তাদের সম্মতি আছে কিনা তা দেখা হবে, তারা রাজি থাকলে তাদের দিয়েই তাদের গার্জিয়ানকে বলানো হবে। গার্জিয়ান রাজি না থাকলে তাদের বাদ দেয়া হবে। আমাদের মাঝখান থেকে কারও কাছে কোন কথা শুনতে হবে না।
মিনু আর আশাকে বলার পর তারা রাজি হল এবং গার্জিয়ান পর্যায়ে সম্মতি পাওয়া গেল।
.
শুটিংয়ের ডেট ঠিক করা হল। জিয়ন শুটিং লোকেশনের ব্যবস্থা করে দিল। ক্যামেরা, ট্রাইপড আনা হল।
.
শুটিং এর দিন সকাল। হঠাৎ লিমনের ফোন। ঠান্ডা গলায় বলল তারপক্ষে কাজ করা সম্ভব না, বাসায় সমস্যা। এই সমস্যার সাথে আমি পরিচিত। কোন কিছু করতে গেলে শুরু হবার পর তার বাসায় সমস্যা হয়। সে থাকে না।
কি আর একাই করব। ঠিক করে রাখা অভিজ্ঞ অভিনেতাকে ফোন দিলাম। ফোন বন্ধ। শেষ পর্যন্ত তার কাছে গেলাম। গিয়ে তার ছোট ভাইয়ের সাথে কথা হল। বড় ভাই কোথায় সে কিছুই জানে না। :3
আবার আশা ছেড়ে দিলাম। হবে না। সম্ভব না। কিছুই করার নাই এখন।
সবাইকে জানিয়ে দিলাম শুটিং ফুটিং কিছু হবে না।
ক্যামেরা ট্রাইপড যেহেতু আছে ঠিক করলাম ফুলসাগরের ভিডিও করে নিয়ে আসি। কি আর করা যাবে।
বের হবার সময় ভাবলাম লিমনের সাথে দেখা করে যাই। দেখা করতে গিয়ে লিমনের বাবার সাথে দেখা হল। ওনাকে সব খুলে বললাম। তিনি লিমনকে ছাড়লেন। কেন ছাড়লেন জানি না, কখনও এমন হয় না। ওকে নিয়ে ফুলসাগরের দিকে রওনা দিলাম। ট্রাইপড কাধে নিয়ে হাঁটা শুরু হল।
.
থানার সামনে দিয়ে যাচ্ছি। কাঁধে ট্রাইপড, হাতে ক্যামেরা। একজন পুলিশ আমাদের থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল, কিসের ক্যামেরা, কিসের শুটিং। তখনও বুঝিনি কি হতে যাচ্ছে। তিনি আমাদের কাহিনী শুনলেন (সম্ভবত একে করুণ বলা উচিত)। তিনি বললেন কোন চিন্তা নেই, তিনি অভিনয় করবেন আমাদের শর্টফিল্মে। ফোন দিয়ে আশা আর মিনুকে ডাকা হল, নোমান (শিশুশিল্পী) কে ডাকা হল। ফিরে আসার সময় রাজু ভাইয়ের সাথে দেখা হল। লিমন কিভাবে যেনো অভিনয়ে তাকে রাজি করিয়ে ফেললো। রাজু ভাই আবার আবার আরও একজন তার পরিচিত মানুষকে রাজি করিয়ে ফেললেন।
.
শুটিং শুরু হল। হ্যা সত্যি সত্যি শুটিং শুরু হল! লিমন গামছা ঘাড়ে নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে, সব ঠিকঠাক করছে। অন্যদিকে আমি অভিনেতাদের ডায়লগ বুঝিয়ে দিচ্ছি, জিয়ন ক্যামেরা ঠিক করছে, নীরব তার নতুন ফোনে আমাদের ছবি তুলছে, আমার ছোট ভাই প্রতীক, তার বন্ধু নুরনবী বাকি নাম না জানাদের দলবল নিয়ে শুটিং দেখতে আসা দর্শকদের ভীড় সামলাচ্ছে, চুপ করাচ্ছে, মুন্না করার মত কাজ না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সার্কাস দেখছে।
সবাই যে যার মত কাজ করে গেলাম।
মাঠে শুটিং হল। আঙ্গিনায় শুটিং হল। ফুলসাগরে হল। বাড়ির বারান্দায় হল। তখন সবাই কাজে ব্যস্ত। কোন অসুবিধাই আর গায়ে লাগল না।
.
সব শুটিং শেষে বাসায় আনার পর দেখা গেল সাউন্ডে গড়বড় হয়ে গেছে। আরও একদিন পুনরায় শুটিং করা হল।
.
এবার এডিটিং এর পালা। এডিটিং করতে গিয়ে বুঝলাম কাজ প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার মত হয়নি। ভিডিওতে আমি নিজেই হাজারটা ভুল বের করছি, প্রতিযোগীতার বিচারকরাতো লাখ খানেক ভুল পেয়ে যাবে। প্রতিযোগীতায় অংশ নেয়ার চিন্তা বাদ দিলাম।
.
এডিটিং শেষ হল। তখন ২০১৪ সাল, এখনকার মত আনলিমিটেড নেটের রাজ্যে বাস করি না। তাই শেয়ার ইট আর ব্লুটুথই ভরসা। যারা চাইলো, দিলাম।
.
এবার সবর্শেষ কথায়। তা হল আমি যে একটি শর্টফ্লিম বানিয়ে ফেললাম, তার বিনিময়ে আমি এবং আমার ইউনিটের সবাই কি পেল।
তাদের মাঝে আমি শুধু একবার এক কেজি জিলাপি কিনে দিয়েছিলাম। বিশের উপরে মানুষ ছিল। যে যতটুকু সেদিন খেয়েছিল এটুকুই তাদের সর্বমোট পাওয়া। তাদের ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারিনি। এডিটিং শেষ হতেই কাউকে কিছু না বলে আমি ঢাকা চলে আসি ভার্সিটির ভর্তি কোচিং করতে।
লিমনের কথা বাদ দেই, সে বন্ধু মানুষ।
জিয়ন সম্ভবত শুটিংএই আমার উপর মন খারাপ করেছিল। কেন করেছিল এখনও জানি না।
আশা এবং মিনুর সাথে কয়েকবার ফেসবুকে কথা হয়েছিল। কিন্তু তারা অভিনয়ে রাজি হবার কারণে আমার বা আমাদের যে কি উপকারটা হয়েছিল তা তাদের বলিনি। তারা রাজি না হলে হয়ত এই শর্টফ্লিমটাই হত না। তাদের কোন ভাষায় বোঝাতে পারব না দুজনই কত ইম্পর্টেন্ট ছিল।
সেই পেপার পড়া বাবার চরিত্রের লোকটার সাথে, তার বউয়ের সাথে পরে কোন যোগাযোগ করতে পারিনি। তাদের দোকান বন্ধ ছিল এরপর থেকে। তবে তাদের বাসায় ডিভিডি পৌছে দেয়া হয়েছে।
সেই পুলিশ ভাই আমার বাসা পর্যন্ত এসেও তার অভিনয় দেখতে পারেননি। আমি যখন ফুলবাড়ি এসে ওনার খোজ নেই তখন শুনি উনি বদলি হয়ে চলে গেছেন। হয়ত এতদিন পরও ওনার এত ভাল অভিনয় করা শর্টফ্লিমটা দেখতে পারেননি।
আর আমি। আমি কি পেয়েছি? সত্যি বলতে স্বার্থপরের মত যা লাভ সবটুকুই আমি পেয়েছি।
সবাই এই শর্টফ্লিমকে আমার শর্টফ্লিম হিসেবে জানে। হ্যা, কোন টাকা পয়সা পাইনি কিন্তু ক্রেডিটতো দেয় আমাকে। কেউ কোন অভিনেতা বা আর কে আছে এর পেঠনে এগুলোর খোজ করে না।
আমাকে দেয়া প্রতিটা ক্রেডিট আমার গায়ে লাগত। এজন্য আমি একরকম লজ্জাতেই আমার জীবনের এই অংশটুকু দুই বছরের কাছাকাছি লুকিয়ে রেখেছিলাম।
.
কিছুদিন আগে মিনু আমার কাছে ভিডিওটা অনলাইনে চাইল। আপলোড দিতে গিয়ে মনে পড়ল সবকথা। তখনই প্লান করলাম কি কি করব। এটা সেই প্লানের শেষ অংশ।
আমি সবার কাছে আমার স্বার্থপরতার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। সত্যিকারের ক্ষমা। কিছুতো দিতে দিতে পারিনি, বিনা খরচায় দিতে পারা ধন্যবাদটা আজ দেই। অসংখ্য, অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে এই শর্টফ্লিমটায় কাজ করার জন্য।
এবং আপনি পড়ছেন, আপনাকেও ধন্যবাদ এতদূর পড়ার জন্য। সবাই ভাল থাকবেন।
Comments
Post a Comment