নদী বাংলাদেশের প্রকৃতির অবারিত অপরূপ এক সৌন্দর্য!
বাংলাদেশের ছয়টি ভিন্ন ঋতুতে এই নদী নিজেকে মেলে ধরে নানা রূপে! বাংলাদেশের নদী মানে বাঙ্গালীর নিজস্ব জীবনধারার কিছু চিত্র। সাধারন মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদী।
নদীকে তার গঠন অনুযায়ী শাখা নদী, উপ-নদী, প্রধান নদী, নদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যায়। আবার ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ছোট নদীকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়।
প্রধান নদী সাধারণত নদী ব্যতিত অন্য কোন উৎস হতে সৃষ্টি হয়, যেমন পদ্মা গঙ্গোত্রী হিমবাহ হতে উৎপন্ন হয়েছে। শাখা নদী অন্য কোন নদী হতে উৎপন্ন হয়। যেমন বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর শাখা নদী। উপ-নদী সাধারণত অন্য কোন নদীতে গিয়ে মেশে, যেমন আত্রাই নদী। কোন প্রধান নদী অন্য নদীর উপ-নদীও হতে পারে। বাংলাদেশের বহ্মপুত্র, কিংবা আফ্রিকার নীল এক ধরণের নদ।
বাংলাদেশে ছোট-বড় সাত শতাধিক নদী আছে। তন্মধ্যে কিছু নদী মৃতপ্রায়। বর্ষাকালে নদীগুলো বেশ সজীব, জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। তখন নদীর ভরাযৌবন দেখা যায়। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কুশিয়ারা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, তিস্তা ইত্যাদি এ দেশের প্রধান নদী। রংপুর বিভাগের নদীগুলো হল দুধকুমার, রাইডাক, ধরলা, তিস্তা, স্বাতি, বুড়িখোড়া-চিকি, খারভাজা, ঘাগট, যমুনেশ্বরী, আখির, খারখরিয়া, বাসমাই, দেওনাই, চিকি, নীলকুমার, ভরোলা, গদাধর, সনকোশ, নোয়াডিহিং, ডিসাঙ্গ, ডিখু, কালাঙ্গ, কাপিলি, তিতাস-গিরি, ব্রহ্মপুত্র: (২৬টি)। ধরলা নদী ফুলবাড়ি উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে।
ধরলা নদী-
![]() |
Dhorla River fulbari kurigram |
Dhorla River
ধরলা নদী (Dharla River) একটি আন্তঃসীমান্ত নদী; লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের চ্যাংগ্রাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ভারতে অবস্থিত উজান প্রবাহে নদীটি জলঢাকা অথবা শিংগিমারি নামে পরিচিত। পাটগ্রাম পুলিশ স্টেশনের কাছে নদীটি পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে মোটামুটি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। অকস্মাৎ এটি দক্ষিণে বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করে সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়েছে। ধরলার ডান তীরে কুড়িগ্রাম শহর। কুড়িগ্রাম শহরের কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। রংপুরে নীলকুমার নামে ধরলার একটি ছোট উপনদী আছে। বর্ষার শুরুতে ধরলাতে স্রোত খুব বেড়ে যায় এবং নদীতীরে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ খুব হ্রাস পায়; বিশেষত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নদী খাত প্রায় শুষ্ক থাকে। এ নদী নিম্ন অববাহিকা বর্ষার শুরুতে পাহাড়ী ঢল জনিত আকস্মিক বন্যা কবলিত হয়। নদী তীর অধিকমাত্রায় বেলে যুক্ত ও ঢাল বেশি হওয়ায় ভাঙ্গন প্রবণতা অধিক। প্রায় প্রতি বছরই নদী তীরবর্তী প্লাবনভূমি বর্ষায় বন্যা কবলিত হয়। বাংলাদেশ অংশে নদীটির মোট দৈর্ঘ্য ৭৫ কিমি।
উৎপত্তি
এই নদীটির উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের জলঢাকা বা শিংগিমারি থেকে।
দৈর্ঘ্য এবং গভীরতা
বাংলাদেশ অংশে ধরলার দৈর্ঘ্য ৭৫ কিলোমিটার। এর গড় গভীরতা ১২ ফুট বা ৩.৭ মিটার এবং কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৯ ফুট বা ১২ মিটার।
উপনদী
রংপুরের কাছে নীলকুমার নামে ধরলার একটি উপনদী রয়েছে।
ধরলা নদীর বৈশিষ্ট্য-
বারোমাসি প্রকৃতির এবং নদীটি জোয়ারভাটা প্রভাবিত নয়। নদীটি বন্যাপ্রবণ, নদী অববাহিকায় কুড়িগ্রাম বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্প আছে। নদীতে ব্যারাজ বা রেগুলেটর নেই, তবে ডানতীরে ৪৯ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বন্যানিয়ন্ত্রণ
বাঁধ আছে। নদীর তীরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম পৌরসভা, পাটগ্রাম পৌরসভা, সামাসপাড়া হাট, কাশিয়াবাড়ি হাট ও সিংড়া অবস্থিত।
সৌন্দর্য-
![]() |
Dhorla river fulbari |
ধরলা নদী রবি ঠাকুরের সেই ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার নদীটি মিলে যায়। শীত ও শীতের পরে গ্রীষ্মেও হাটু পানি থাকে প্রায়। কিন্তু বর্ষা কালে ঠিক উল্টো। প্রবল তান্ডব তুলে ধেয়ে চলে। নদীর পাড়ে বিরাট বালুকাবেলা। নদীতে সবসময়ই ছোট ছোট নৌকা ভেসে বেড়ায়। কেউ মাছ ধরে, কেউ যাত্রী পারাপার করে। রয়েছে পালতোলা নৌকা আবার ইঞ্জিন চালিত নৌকাও।
শরতকালে নদীর পাড় জুড়ে কাশফুল ফুটে সাদা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে ভরা নদীতে পাক ওঠে। কুল ছাপিয়ে তা কখনও বন্যাতেও রূপ নেয়।
সকাল বেলা অনেকেই নদীর তাজা মাছ কিনতে নদীর পাড়ে চলে আসে। প্রতিদিন বিকেলে নদীর পাড়ে সৌন্দর্য পিপাসু দর্শনার্থীদের আনাগোনা থাকে। পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখা যায়। রাতে বসে তারার মেলা। স্বল্প ঢেউয়ের কুলকুল শব্দ নীরবতা ভেদ করে কানে আসে। অবশ্য এক সময় খরস্রোতা ছিল ধরলা নদী! পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জের লোকজন বড় বড় নৌকা নিয়ে ব্যবসা করার জন্য এই এলাকায় আসত।
বর্তমাস অবস্থা-
ধরলায় শুধু বালুচর আর বালুচর। গভীরতা কমে যাওয়ায় মানুষজন হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে ধরলার বুক দিয়ে। অনেক স্থানে নদীটির বুক যেন এখন আবাদি জমি। ধরলা শুধু এখন কালের সাক্ষী। ধরলার তীরবর্তী হাজার হাজার হেক্টর জমি ইরি-বোরো আবাদের চরম হুমকির মুখে। সেচ পাম্পগুলো দিয়ে পর্যাপ্ত পানি উত্তোলন না হওয়ায় হাজার হাজার কৃষক দিশেহারা। নদীটির মধ্য ভাগে কোথাও কোথাও জেগে উঠেছে চর। এমনি বৃহৎ আকারে দ্বীপচর জেগে উঠেছে ফুলবাড়ির শিমুলবাড়ি ও নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের চরযতীন্দ্র নারায়ণ, চরপেচাই, চরগোরক এবং লালমনিরহাটের চরখারুয়া, বোয়ালমারি এবং অধুনালুপ্ত ছিটমহল বাঁশপেচাইকে নিয়ে। চতুর্দিকে ধরলা বেষ্টিত এ দ্বীপ চরটিতে প্রায় ২০ হাজার লোকের বসবাস। নাব্যতা না থাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ডিঙ্গি নৌকা চলাচল সম্ভব হচ্ছে না।
![]() |
Dhorla River |
ফলে দেশের মূল ভূখ-ের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাত্র পথ ¯স্রোতহীন ধরলার গুয়াবাড়ি ঘাটের বাঁশের সাঁকো পাড়ি দেয়া। এখানকার যে পরিবারগুলো এক সময় ধরলার মাছ শিকার করে জীবন-জীবিকা চালাতো তারা তাদের দীর্ঘ দিনের পেশা হারিয়ে কেউবা দিনমজুর, কেউবা বাড়িঘর ছাড়া, আবার কেউবা বেকার জীবনযাপন করছে। বিশেষ করে অসংখ্য চরাঞ্চল সৃষ্টি করে এক সময়কার খরস্রোত ধরলাটি মরা নদীতে পরিণত হওয়ায় সেখানকার মানুষজনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে অসংখ্য চর জেগে ওঠা ধরলা নদী ফুলবাড়ী উন্নয়নের একমাত্র অন্তরায় বলে ভুক্তভোগী মানুষজন জানিয়েছেন। হাজার হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। চরম বিপর্যয় ঘটছে এ এলাকার কৃষিতে। বিনষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। স্বচ্ছ ও সুপেয় পানির অভাবে এ এলাকার মানুষজন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে পানিবাহিত রোগে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই আছে। ফলে এ অঞ্চলে মরুকরণ লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
![]() |
beautiful river dhorla |
ধরলা পাড়ে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন ধরলার তীরবর্তী স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। সোনাইকাজী গ্রামে ধরলার পাড়ে বিএডিসির গভীর নলকূপটি দিয়ে আর পানি উত্তোলন করা সম্ভব হচ্ছে না। ধরলায় এখন আর পানি নেই। শুধু চর আর চর।
ধরলা শুধু বর্ষা মৌসুমে বোঝা যায়। ধরলার নাব্যতা কমে পানিও শুকিয়ে গেছে, আমাদের একমাত্র বৃষ্টি ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পার্শ্ববর্তী কুটিচন্দ্রখানা জেলেপাড়া গ্রামের প্রায় ১শ’ পরিবার তাদের বাপ-দাদার পেশা ধরে আছে মাত্র ১০-১৫টি পরিবার। অন্যরা এ পেশা ছেড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রিকশা চালায়, কেউবা অন্যের দোকানে, কেউবা মাটি কাটার কাজ করছে। কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তিও করছে।
ফুলবাড়ী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী সরকার বলেন, এ নদীটি পুনঃউদ্ধার করতে হলে তলদেশ খনন এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা গেলে নদীটি আবার তার খর¯্রােত ফিরে পাবে। তাছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অবস্থা। ধরলা নদী আসলে আমাদের উন্নয়নের অন্তরায়। তিনি ধরলা খনন ও ভাঙন রোধের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
Comments
Post a Comment