১.
বিকেলের রোদ জানালা দিয়ে ঘরে আসছে। সন্ধ্যে নামতে তখনও অনেক দেরি। অন্তর হাফিজের ঘরে ঢুকে প্রথমে জানালাগুলো বন্ধ করে পর্দা টেনে দিল। মিথিলার আধা চেতন অাধা অচেতন শরীর সোফাতে পড়ে আছে। সোফা থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। ওড়নাটা সোফাতে পড়ে। মিথিলা বিড়বিড় করে একবার হাফিজ হাফিজ বলল। পাশে থাকা চেয়ারটায় বসল অন্তর। মিথিলার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলো, এই তো সুযোগ।
২.
হাফিজের বাড়িটা রাস্তার পাশে।দোতলা বাড়ি। আশে পাশের বাড়িগুলো গুলো একটু দূরে দূরে।
৩.
হাফিজ ক্লাশে ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত।প্রথম থেকেই সামনের দিকে বসে। আজকেও তাই। কিন্তু আজ সামনে বসলেও ম্যামের কোন কথাই কানে ঢুকছে না। ক্লাশ শেষ হলে মিথিলার সাথে দেখা করতে হবে। আজকে মিথিলার সাথে ঝগড়াটা কোন দিকে টার্ন করাতে হবে সেটা নিয়ে ক্লাশের মাঝে পরিকল্পণা করতে থাকে সে।
৪.
মিথিলা মেয়েটা দেখতে ফর্সা। এদেশে ফর্সা মানেই সুন্দর। মিথিলার মত মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে রাখা যেকোন ছেলের জন্য ভাগ্যই বলতে হবে। মিথিলা সেটা জানত। কয়েকটা প্রোপজের মাঝে আদনান ছেলেটা তার সাথে যায়। তাই বেছে বেছে অাদনানের সাথে রিলেশন শুরু করল। প্রথমে মিথিলা সিরিয়াস ছিল না কিন্তু কোথা থেকে যেন ভালবাসা উড়ে এসে জুড়ে বসল মিথিলার উপর। মেয়েরা কোন ছেলেকে আসলেই ভালবেসে ফেললে তাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ সাজাতে থাকে। মিথিলা আদনানকে ভালবেসে ফেলার পর ভবিষ্যতে কি করবে, সংসার সাজাবে কিভাবে এসব মনের আনন্দে ভাবতে লাগল। কিন্তু ভবিষ্যৎ আঁকাআঁকির মাঝখানে আদনান বৃষ্টির সাথে রিলেশন শুরু করে মিথিলাকে একরকম ছুড়েই ফেলল। আদনান তাকে এভাবে ছুড়ে ফেলবে সে কোন ভাবে কল্পণা করতে পারেনি। এই মানুষটা ছাড়া সে কিভাবে বাঁচবে! সেতো আদনানের জায়গায় অন্যকোন পুরুষকে কল্পণাই করতে পারবে না মেনে নেয়াতো দূরে থাক। কষ্ট সইতে না পেরে প্রথমে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল। পরে সেটা বাদ দিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিল। ব্রেকআপের ছয় দিনের মাঝেই আদনানকে দেখাতে হাফিজ নামের এলাকার গোবেচারা ছেলেটার সাথে রিলেশন করে ফেলল।
৫.
মিথিলার সাথে হাফিজের ফেসবুকে বন্ধুত্ব, ফেসবুকেই প্রেম। মেয়েরা ছেলেদের কাছে কোন কাজ হাসিল করতে চাইলে সুন্দর ভাবে ছেলেদের কথার প্যাঁচে ফেলে কাজ উদ্ধার করতে পারে। মিথিলা তাই করল। তার একটা ছেলের দরকার ছিল। জাস্ট একটা ছেলে। যার সাথে ফেসবুকে ইন এ রিলেশনশিপ স্টাটাস দিয়ে তার এক্স বয়ফ্রেন্ড আদনানকে দেখাতে পারে যে হ্যা সেও রিলেশন করতে পারে। মিথিলা হাফিজের কাছে সব কথা জানাল। তার দুঃখের আবেগটা সত্যি ছিল কিন্তু আবেগের মাঝে হাফিজকে হাত করার মন্ত্রও রেখে ছিল। হাফিজ মন্ত্রমুগ্ধ ছাগলে পরিণত হল। তারপর কি করবে বুঝতে না পেরে অন্তরের সাথে দেখা করল।
৬.
অন্তর হাফিজের ক্লাশ ফ্রেন্ড। গাজা, মদ সব খায়। ক্লাশে সবার পেছনে বসে। কলেজে গেলে বাসা থেকে টাকা পাওয়া যায় জন্য বাধ্য হয়ে কলেজে যেতে হয়। অন্তর আর হাফিজের বাড়ি এক এলাকায় হওয়ায় দুজনে একসাথে কলেজে যায়। হাফিজ যখন অন্তরকে মিথিলার ব্যাপারটা বলেছিল সেটা এমন ছিল।
অন্তর- আচ্ছা তারপর?
হাফিজ- মিথিলা সারাদিন কাঁদে। কাল ফোন নম্বর দিয়েছিলাম। আজ ও নিজেই আমাকে ফোন করে কাঁদছিল।
অন্তর - অ। তারপর?
হাফিজ- তারপর সে আত্মহত্যার কথা বলল, তাকে কেউ আপন ভাবে নাই। আমি বললাম আমিতো আছি। সে বলল আমিও নাকি ছেড়ে চলে যাবো।
অন্তর- তুই কি বললি?
হাফিজ- আমি বললাম কখনই ছেড়ে যাবো না। কি আর বলি বল। সে কি বলল জানিস?
অন্তর - কি?
হাফিজ- আমি নাকি গার্লফ্রেন্ড পেলেই তাকে ছেড়ে দেবো। আমিতো বললাম কোনদিনও যাবো না।
অন্তর - মেয়েতো সিঙ্গেল প্রোপজ করে ফেল।
হাফিজ- আরে না। তোর কি মাথা খারাপ হইছে! আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড।
সেই রাতেই হাফিজ মিথিলাকে প্রোপজ করে বসল।
৭.
মিথিলা হাফিজের উপর কোন আগ্রহ পায় না। আদনান আর হাফিজ দুজন দু মেরুর। আদনান লম্বা, ফর্সা, চালাক ছেলে। সবচেয়ে বড় গুণ হল তার সাহস। এদিকে হাফিজ প্রথমত বোকা, দ্বিতীয়ত তাকে নিয়ে গর্ব করার মত কিছু নাই, এদিকে এভারেজ চেহারা, সাহসের কোন নমুনা এখনো দেখেনি। সে ক্লাশে প্রথম সারির ছাত্র ছিল। এখন প্রেম শুরুর পর পড়াশোনাটাও ঠিকমত করে না। সারাদিন মিথিলার পেছনে লেগে থাকে। আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা নিয়েই ঝগড়া শুরু হয়েছে দুজনের। হাফিজের কথা হল কেন মিথিলা ঘুম থেকে ওঠার পর তাকে ফোন করেনি। মিথিলা প্রথমে ভেবেছিল এটা একটা ছোট ব্যাপার। সে হালকা ভাবেই বলল, "মনে ছিল না"। "আমাকে তো মনে থাকবেই না" বলে হাফিজ তেড়েফুঁড়ে ঝগড়া শুরু করল তখন থেকে।
৮.
হাফিজের ক্লাশ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সে মিথিলাকে মেসেজে বলল সে মাঠে আছে দেখা করতে চায়। মিথিলা মেসেজেই জানালো তার সাথে কোন কথা নাই। অন্তর তাদের ঝগড়া দেখে মজা পাচ্ছিল। সস্তায় পিনিক।
সে হাফিজকে বলল, "এত ঝগড়া না করে মেয়েরে বাসায় নিয়ে যা, আন্টি আঙ্কেলতো শুনলাম তোর দাদাবাড়িতে, তোর তো বাসা ফাঁকা, এই সুযোগতো পাবি না।"
হাফিজ বলল "ধুর, কি যে বলিস। আমি ওকে কতটা ভালবাসি সেটা তুই চিন্তাই করতে পারবি না। আমার জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারব।"
অন্তর- তাহলে ঝগড়া করিস কেন?
হাফিজ-এটাইতো বুঝলি না। পাখির (রিলেশনের পর মিথিলাকে পাখি বলে ডাকতো হাফিজ) সাথে যে এত ঝগড়া করি কারণ আছে। সারাদিন ঐ একই কি করি, কি খাই এইসব আর কত বলি! কিন্তু দেখ ঝগড়া করলে পুরোটাই অন্যরকম হয়ে যায়। ও ঝগড়ায় জেতার জন্য কত কিছু করে। এটা ভাল লাগে। ঝগড়া আবার মিটেও যায়। এই যে এখন ঝগড়া হল বিকেলে আবার ঠিক হবে। বিকেলে আরেক বিষয়ে ঝগড়া করব রাতে ঠিক হবে। অনেক মজা লাগে ব্যাপারটা।"
অন্তর বলল, "বুঝলাম। ঝগড়া কর ঠিক আছে কিন্তু তোর ফাঁকা বাসার সুযোগতো বারবার পাবি না। রিলেশনে মেয়েদের আটকে রাখতে হলে ফাঁকা বাসায় নিতেই হবে না হলে পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।"
হাফিজ,"না না, পাখি বলছে বিয়ের আগে এসব না।"
হাফিজ সেদিন বিকেলেই মিথিলাকে ফাঁকা বাসায় আসতে বলল।
৯.
মিথিলা বুঝতে পারছে না কি করবে! হাফিজ লিখে পাঠিয়েছিল সে যদি সত্যিই হাফিজকে ভালবেসে থাকে তবে সেটা যেন প্রমাণ করে দেখায়। সে লিখে পাঠালো সে হাফিজকে ভালবাসে, এর জন্য যা প্রমাণ করতে হয় সে করতে রাজি আছে। মিথিলা কোনদিন ভাবেনি হাফিজ প্রমাণ হিসেবে তাকে তার খালি বাসায় ডাকবে। মিথিলা অনেক কিছু চিন্তা করল এবং শেষে রাজি হল। রাজি হবার বড় কারণ হল হাফিজ কে ভালবেসে ফেলেছে। যদিও ঘর বাঁধার স্বপ্ন এখনো দেখেনি। আর দ্বিতীয় কারণ হল সে তার এক্স বয়ফ্রেন্ড আদনানের খালি বাসায় কয়েকবার গিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিল খালি বাসায় যাওয়াটা অনেক রোমাঞ্চকর কোন ব্যাপার। কিন্তু এখন এতে আর কোন নতুন কিছু নেই। ছেলেরা মেয়ের গন্ধ পাবার পর থেকে পশু হয়ে যায়। বাইরে দেখানো স্মার্টনেস, হিতাহিত জ্ঞান সব হারিয়ে ফেলে। প্রথমদিকে ভাল লাগলেও পরে ব্যাপারটা মিথিলার একঘেয়ে লাগত। হাফিজ যেহেতু প্রথমবার ডাকলো সেহেতু কি কি হয় তা দেখার একটা লোভ জাগল।
১০.
হাফিজ ভেবেছিল মিথিলা রাজি হবে না। রাজি হয়েছে দেখে উল্টো সেই বিপদে পড়ল। কি করা যায়! কি করা যায়! ভাবতে ভাবতে সে অন্তরকে ফোন করে ব্যাপারটা বলল। অন্তর শুনে বলল সে আসছে।
১১.
অন্তর এ লাইনে পুরনো। সে দোকানে গিয়ে কি কি নিতে হবে সে সব কিনে হাফিজের বাসায় উপস্থিত হল। হাফিজ ঘর গোছাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছে আবার লজ্জা লজ্জা লাগছে। সোজা অন্তরের দিকে তাকাতেও পারছে না। এদিকে অন্তর ফ্রিজ খুলে আপেল নিয়ে খেতে খেতে বলল, "প্রথমে এখানে বসাবি ঠিক আছে? "
হাফিজ বলল "চুপ করবি?"
১৪.
কিছুক্ষণ আগে মিথিলা এসেছে। মিথিলা হাফিজ দুজনই ঘরে। মিথিলা ঘরে ঢুকেই দেখলো জানালা বন্ধ।
মিথিলা বলল - এই, জানালা দরজা সব বন্ধ কেন? এসব বন্ধ থাকলে আমি এখনি চলে যাবো।
হাফিজ- কেউ দেখে ফেললে প্রবলেম আছে।
মিথিলা- প্রবলেম হবে কেন। আমরা কি প্রবলেম হবার মত কিছু করব নাকি?
হাফিজ হাসে।
মিথিলা- কি হল হাসো কেন? যাও জানালা খোলো। কি হল যাও।
হাফিজ জানালা খোলে।
মিথিলা- তুমি ভালবাসার প্রমাণ চাইলে। এই যে এলাম। কি বুঝলে?
হাফিজ- ভালবাসো।
মিথিলা- অার তুমি ভালবাসোতো?
হাফিজ- এত ভালবাসি তুমি কল্পণাও করতে পারবা না।
মিথিলা- সত্যিতো?
হাফিজ- হুম।
মিথিলা- তোমাদের ঘরগুলো অনেক গোছানো।
হাফিজ-এই তোমার গালে কি পড়ছে দেখি দেখি।
মিথিলা- এই এই দূরে বসো বলছি।
হাফিজ-কেন?
মিথিলা- আমার গালে যা পড়ছে পড়ছে তোমাকে দেখতে হবে না।
হাফিজ- কে দেখবে শুনি?
হাফিজ আরো কাছে যায়।
মিথিলা একটু জড়োসড়ো হয় আদুরে গলায় বলে "জানি না। "
হাফিজ আরেকটু কাছে যাবে এমন সময় হাফিজের ফোন বেজে ওঠল।
১৪.
অন্তর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েছিল।তার দায়িত্ব কেউ এলো কি না তার গার্ড দেবে। কেউ এলে এলে হাফিজকে জানাবে।
অন্তর মিথিলা আসার কিছুক্ষণ পর একটা সিগারেট ধরিয়ে হাফিজকে ফোন করল,
অন্তর- কি অবস্থা? কতদূর?
হাফিজ- আরে ধুর, রাখি।
অন্তর - দাঁড়া দাঁড়া,ভ্যাজাল হইছে। বাইরে আয়। তোকে দরকার।
হাফিজ- কি হইছে?
অন্তর- এলে বুঝবি।
হাফিজ তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়ালো।
হাফিজ- তাড়াতাড়ি বল।
অন্তর- তুইতো মজা করবি কিন্তু আমি কি পাবো?
হাফিজ- যা খেতে চাস তাই খাওয়াবো।
অন্তর- না। অন্য কিছু দরকার।
হাফিজ- কি?
অন্তর- মিথিলাকে । একবার।
হাফিজ পুরোপুরি স্তব্ধ হওয়ায় গলায় কথা আটকে গেল।
অন্তর- কি হল?
হাফিজ- না।
অন্তর-তুই যদি এখন এলাকাবাসীর কাছে ধরা পড়িস কি হবে একবার চিন্তা করছিস? তুই, তোর ফ্যামিলি এই বাসায় থাকতে পারবি? মিথিলা এলাকায় থাকতে পারবে ভাবছিস?
হাফিজ- আমি বেঁচে খাকতে না। আমি মিথিলাকে ভালবাসি।
অন্তর- এত ভয় পাচ্ছিস কেন! কত মেয়ে আসবে যাবে। আমি কি বলি শোন। এই যে এই গুলো মিথিলাকে যেভাবে পারিস এখন খাওয়াবি। এটা খাবার পর ওর আর কিছু মনে থাকবে না। কি এত ভাবিস? এটা ছাড়া রাস্তা থাকলে বল। আমি তোর কথাও চিন্তা করছি জন্য এইগুলা আনছি।
হাফিজ- আমি তোকে ভাল বন্ধু ভাবতাম।
অন্তর- অতকথা জানিনা তাড়াতাড়ি বল আমার সিগারেট শেষ।
হাফিজ অবাক হয়ে সামনের কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন সে এই কুকুরটাকে বন্ধু হিসেবে ভাবত!
অন্তর আবার তাগাদা দিল। " মিথিলার কিছু মনে থাকবে নাতো বললাম, এত চিন্তা করিস কেন! দেখ তুই যদি আমার সোজা কথায় না রাজি হোস আমার বন্ধুদের ডাকবো। এতজনকে সহ্য করতে পারবে তো। চিন্তা কর।"
১৬.
অন্তর কিছুক্ষণ আগে মিথিলার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।
হাফিজ রাস্তায় সোজা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে নোনা জলের ঢল নেমেছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। একটু যদি পেছনে ফেরা যেত। মাত্র চার ঘন্টা আগে যখন পাখিকে সে বাসায় আসতে বলেছিল, সেই চার ঘন্টা আগে ফিরে যেতে চায়। সে আর কোনদিন ঝগড়া করবে না, কোনদিন কষ্ট দেবে না, কোন দিন ভালবাসার প্রমাণ চাইবে না শুধু একবার পেছনে ফিরতে চায়। শুধু একবার। বুকের মাঝে হাহাকার করে ওঠে। পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন হয়!
বিকেলের রোদ আকাশে, সন্ধ্যে নামতে তখনও অনেক দেরি। একটা একটা করে জানালাগুলো বন্ধ করে অন্তর।
বিকেলের রোদ জানালা দিয়ে ঘরে আসছে। সন্ধ্যে নামতে তখনও অনেক দেরি। অন্তর হাফিজের ঘরে ঢুকে প্রথমে জানালাগুলো বন্ধ করে পর্দা টেনে দিল। মিথিলার আধা চেতন অাধা অচেতন শরীর সোফাতে পড়ে আছে। সোফা থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। ওড়নাটা সোফাতে পড়ে। মিথিলা বিড়বিড় করে একবার হাফিজ হাফিজ বলল। পাশে থাকা চেয়ারটায় বসল অন্তর। মিথিলার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলো, এই তো সুযোগ।
২.
হাফিজের বাড়িটা রাস্তার পাশে।দোতলা বাড়ি। আশে পাশের বাড়িগুলো গুলো একটু দূরে দূরে।
৩.
হাফিজ ক্লাশে ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত।প্রথম থেকেই সামনের দিকে বসে। আজকেও তাই। কিন্তু আজ সামনে বসলেও ম্যামের কোন কথাই কানে ঢুকছে না। ক্লাশ শেষ হলে মিথিলার সাথে দেখা করতে হবে। আজকে মিথিলার সাথে ঝগড়াটা কোন দিকে টার্ন করাতে হবে সেটা নিয়ে ক্লাশের মাঝে পরিকল্পণা করতে থাকে সে।
৪.
মিথিলা মেয়েটা দেখতে ফর্সা। এদেশে ফর্সা মানেই সুন্দর। মিথিলার মত মেয়েকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে রাখা যেকোন ছেলের জন্য ভাগ্যই বলতে হবে। মিথিলা সেটা জানত। কয়েকটা প্রোপজের মাঝে আদনান ছেলেটা তার সাথে যায়। তাই বেছে বেছে অাদনানের সাথে রিলেশন শুরু করল। প্রথমে মিথিলা সিরিয়াস ছিল না কিন্তু কোথা থেকে যেন ভালবাসা উড়ে এসে জুড়ে বসল মিথিলার উপর। মেয়েরা কোন ছেলেকে আসলেই ভালবেসে ফেললে তাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ সাজাতে থাকে। মিথিলা আদনানকে ভালবেসে ফেলার পর ভবিষ্যতে কি করবে, সংসার সাজাবে কিভাবে এসব মনের আনন্দে ভাবতে লাগল। কিন্তু ভবিষ্যৎ আঁকাআঁকির মাঝখানে আদনান বৃষ্টির সাথে রিলেশন শুরু করে মিথিলাকে একরকম ছুড়েই ফেলল। আদনান তাকে এভাবে ছুড়ে ফেলবে সে কোন ভাবে কল্পণা করতে পারেনি। এই মানুষটা ছাড়া সে কিভাবে বাঁচবে! সেতো আদনানের জায়গায় অন্যকোন পুরুষকে কল্পণাই করতে পারবে না মেনে নেয়াতো দূরে থাক। কষ্ট সইতে না পেরে প্রথমে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল। পরে সেটা বাদ দিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিল। ব্রেকআপের ছয় দিনের মাঝেই আদনানকে দেখাতে হাফিজ নামের এলাকার গোবেচারা ছেলেটার সাথে রিলেশন করে ফেলল।
৫.
মিথিলার সাথে হাফিজের ফেসবুকে বন্ধুত্ব, ফেসবুকেই প্রেম। মেয়েরা ছেলেদের কাছে কোন কাজ হাসিল করতে চাইলে সুন্দর ভাবে ছেলেদের কথার প্যাঁচে ফেলে কাজ উদ্ধার করতে পারে। মিথিলা তাই করল। তার একটা ছেলের দরকার ছিল। জাস্ট একটা ছেলে। যার সাথে ফেসবুকে ইন এ রিলেশনশিপ স্টাটাস দিয়ে তার এক্স বয়ফ্রেন্ড আদনানকে দেখাতে পারে যে হ্যা সেও রিলেশন করতে পারে। মিথিলা হাফিজের কাছে সব কথা জানাল। তার দুঃখের আবেগটা সত্যি ছিল কিন্তু আবেগের মাঝে হাফিজকে হাত করার মন্ত্রও রেখে ছিল। হাফিজ মন্ত্রমুগ্ধ ছাগলে পরিণত হল। তারপর কি করবে বুঝতে না পেরে অন্তরের সাথে দেখা করল।
৬.
অন্তর হাফিজের ক্লাশ ফ্রেন্ড। গাজা, মদ সব খায়। ক্লাশে সবার পেছনে বসে। কলেজে গেলে বাসা থেকে টাকা পাওয়া যায় জন্য বাধ্য হয়ে কলেজে যেতে হয়। অন্তর আর হাফিজের বাড়ি এক এলাকায় হওয়ায় দুজনে একসাথে কলেজে যায়। হাফিজ যখন অন্তরকে মিথিলার ব্যাপারটা বলেছিল সেটা এমন ছিল।
অন্তর- আচ্ছা তারপর?
হাফিজ- মিথিলা সারাদিন কাঁদে। কাল ফোন নম্বর দিয়েছিলাম। আজ ও নিজেই আমাকে ফোন করে কাঁদছিল।
অন্তর - অ। তারপর?
হাফিজ- তারপর সে আত্মহত্যার কথা বলল, তাকে কেউ আপন ভাবে নাই। আমি বললাম আমিতো আছি। সে বলল আমিও নাকি ছেড়ে চলে যাবো।
অন্তর- তুই কি বললি?
হাফিজ- আমি বললাম কখনই ছেড়ে যাবো না। কি আর বলি বল। সে কি বলল জানিস?
অন্তর - কি?
হাফিজ- আমি নাকি গার্লফ্রেন্ড পেলেই তাকে ছেড়ে দেবো। আমিতো বললাম কোনদিনও যাবো না।
অন্তর - মেয়েতো সিঙ্গেল প্রোপজ করে ফেল।
হাফিজ- আরে না। তোর কি মাথা খারাপ হইছে! আমরা জাস্ট ফ্রেন্ড।
সেই রাতেই হাফিজ মিথিলাকে প্রোপজ করে বসল।
৭.
মিথিলা হাফিজের উপর কোন আগ্রহ পায় না। আদনান আর হাফিজ দুজন দু মেরুর। আদনান লম্বা, ফর্সা, চালাক ছেলে। সবচেয়ে বড় গুণ হল তার সাহস। এদিকে হাফিজ প্রথমত বোকা, দ্বিতীয়ত তাকে নিয়ে গর্ব করার মত কিছু নাই, এদিকে এভারেজ চেহারা, সাহসের কোন নমুনা এখনো দেখেনি। সে ক্লাশে প্রথম সারির ছাত্র ছিল। এখন প্রেম শুরুর পর পড়াশোনাটাও ঠিকমত করে না। সারাদিন মিথিলার পেছনে লেগে থাকে। আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা নিয়েই ঝগড়া শুরু হয়েছে দুজনের। হাফিজের কথা হল কেন মিথিলা ঘুম থেকে ওঠার পর তাকে ফোন করেনি। মিথিলা প্রথমে ভেবেছিল এটা একটা ছোট ব্যাপার। সে হালকা ভাবেই বলল, "মনে ছিল না"। "আমাকে তো মনে থাকবেই না" বলে হাফিজ তেড়েফুঁড়ে ঝগড়া শুরু করল তখন থেকে।
৮.
হাফিজের ক্লাশ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সে মিথিলাকে মেসেজে বলল সে মাঠে আছে দেখা করতে চায়। মিথিলা মেসেজেই জানালো তার সাথে কোন কথা নাই। অন্তর তাদের ঝগড়া দেখে মজা পাচ্ছিল। সস্তায় পিনিক।
সে হাফিজকে বলল, "এত ঝগড়া না করে মেয়েরে বাসায় নিয়ে যা, আন্টি আঙ্কেলতো শুনলাম তোর দাদাবাড়িতে, তোর তো বাসা ফাঁকা, এই সুযোগতো পাবি না।"
হাফিজ বলল "ধুর, কি যে বলিস। আমি ওকে কতটা ভালবাসি সেটা তুই চিন্তাই করতে পারবি না। আমার জীবন পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারব।"
অন্তর- তাহলে ঝগড়া করিস কেন?
হাফিজ-এটাইতো বুঝলি না। পাখির (রিলেশনের পর মিথিলাকে পাখি বলে ডাকতো হাফিজ) সাথে যে এত ঝগড়া করি কারণ আছে। সারাদিন ঐ একই কি করি, কি খাই এইসব আর কত বলি! কিন্তু দেখ ঝগড়া করলে পুরোটাই অন্যরকম হয়ে যায়। ও ঝগড়ায় জেতার জন্য কত কিছু করে। এটা ভাল লাগে। ঝগড়া আবার মিটেও যায়। এই যে এখন ঝগড়া হল বিকেলে আবার ঠিক হবে। বিকেলে আরেক বিষয়ে ঝগড়া করব রাতে ঠিক হবে। অনেক মজা লাগে ব্যাপারটা।"
অন্তর বলল, "বুঝলাম। ঝগড়া কর ঠিক আছে কিন্তু তোর ফাঁকা বাসার সুযোগতো বারবার পাবি না। রিলেশনে মেয়েদের আটকে রাখতে হলে ফাঁকা বাসায় নিতেই হবে না হলে পাখি ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।"
হাফিজ,"না না, পাখি বলছে বিয়ের আগে এসব না।"
হাফিজ সেদিন বিকেলেই মিথিলাকে ফাঁকা বাসায় আসতে বলল।
৯.
মিথিলা বুঝতে পারছে না কি করবে! হাফিজ লিখে পাঠিয়েছিল সে যদি সত্যিই হাফিজকে ভালবেসে থাকে তবে সেটা যেন প্রমাণ করে দেখায়। সে লিখে পাঠালো সে হাফিজকে ভালবাসে, এর জন্য যা প্রমাণ করতে হয় সে করতে রাজি আছে। মিথিলা কোনদিন ভাবেনি হাফিজ প্রমাণ হিসেবে তাকে তার খালি বাসায় ডাকবে। মিথিলা অনেক কিছু চিন্তা করল এবং শেষে রাজি হল। রাজি হবার বড় কারণ হল হাফিজ কে ভালবেসে ফেলেছে। যদিও ঘর বাঁধার স্বপ্ন এখনো দেখেনি। আর দ্বিতীয় কারণ হল সে তার এক্স বয়ফ্রেন্ড আদনানের খালি বাসায় কয়েকবার গিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিল খালি বাসায় যাওয়াটা অনেক রোমাঞ্চকর কোন ব্যাপার। কিন্তু এখন এতে আর কোন নতুন কিছু নেই। ছেলেরা মেয়ের গন্ধ পাবার পর থেকে পশু হয়ে যায়। বাইরে দেখানো স্মার্টনেস, হিতাহিত জ্ঞান সব হারিয়ে ফেলে। প্রথমদিকে ভাল লাগলেও পরে ব্যাপারটা মিথিলার একঘেয়ে লাগত। হাফিজ যেহেতু প্রথমবার ডাকলো সেহেতু কি কি হয় তা দেখার একটা লোভ জাগল।
১০.
হাফিজ ভেবেছিল মিথিলা রাজি হবে না। রাজি হয়েছে দেখে উল্টো সেই বিপদে পড়ল। কি করা যায়! কি করা যায়! ভাবতে ভাবতে সে অন্তরকে ফোন করে ব্যাপারটা বলল। অন্তর শুনে বলল সে আসছে।
১১.
অন্তর এ লাইনে পুরনো। সে দোকানে গিয়ে কি কি নিতে হবে সে সব কিনে হাফিজের বাসায় উপস্থিত হল। হাফিজ ঘর গোছাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছে আবার লজ্জা লজ্জা লাগছে। সোজা অন্তরের দিকে তাকাতেও পারছে না। এদিকে অন্তর ফ্রিজ খুলে আপেল নিয়ে খেতে খেতে বলল, "প্রথমে এখানে বসাবি ঠিক আছে? "
হাফিজ বলল "চুপ করবি?"
১৪.
কিছুক্ষণ আগে মিথিলা এসেছে। মিথিলা হাফিজ দুজনই ঘরে। মিথিলা ঘরে ঢুকেই দেখলো জানালা বন্ধ।
মিথিলা বলল - এই, জানালা দরজা সব বন্ধ কেন? এসব বন্ধ থাকলে আমি এখনি চলে যাবো।
হাফিজ- কেউ দেখে ফেললে প্রবলেম আছে।
মিথিলা- প্রবলেম হবে কেন। আমরা কি প্রবলেম হবার মত কিছু করব নাকি?
হাফিজ হাসে।
মিথিলা- কি হল হাসো কেন? যাও জানালা খোলো। কি হল যাও।
হাফিজ জানালা খোলে।
মিথিলা- তুমি ভালবাসার প্রমাণ চাইলে। এই যে এলাম। কি বুঝলে?
হাফিজ- ভালবাসো।
মিথিলা- অার তুমি ভালবাসোতো?
হাফিজ- এত ভালবাসি তুমি কল্পণাও করতে পারবা না।
মিথিলা- সত্যিতো?
হাফিজ- হুম।
মিথিলা- তোমাদের ঘরগুলো অনেক গোছানো।
হাফিজ-এই তোমার গালে কি পড়ছে দেখি দেখি।
মিথিলা- এই এই দূরে বসো বলছি।
হাফিজ-কেন?
মিথিলা- আমার গালে যা পড়ছে পড়ছে তোমাকে দেখতে হবে না।
হাফিজ- কে দেখবে শুনি?
হাফিজ আরো কাছে যায়।
মিথিলা একটু জড়োসড়ো হয় আদুরে গলায় বলে "জানি না। "
হাফিজ আরেকটু কাছে যাবে এমন সময় হাফিজের ফোন বেজে ওঠল।
১৪.
অন্তর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েছিল।তার দায়িত্ব কেউ এলো কি না তার গার্ড দেবে। কেউ এলে এলে হাফিজকে জানাবে।
অন্তর মিথিলা আসার কিছুক্ষণ পর একটা সিগারেট ধরিয়ে হাফিজকে ফোন করল,
অন্তর- কি অবস্থা? কতদূর?
হাফিজ- আরে ধুর, রাখি।
অন্তর - দাঁড়া দাঁড়া,ভ্যাজাল হইছে। বাইরে আয়। তোকে দরকার।
হাফিজ- কি হইছে?
অন্তর- এলে বুঝবি।
হাফিজ তড়িঘড়ি করে এসে দাঁড়ালো।
হাফিজ- তাড়াতাড়ি বল।
অন্তর- তুইতো মজা করবি কিন্তু আমি কি পাবো?
হাফিজ- যা খেতে চাস তাই খাওয়াবো।
অন্তর- না। অন্য কিছু দরকার।
হাফিজ- কি?
অন্তর- মিথিলাকে । একবার।
হাফিজ পুরোপুরি স্তব্ধ হওয়ায় গলায় কথা আটকে গেল।
অন্তর- কি হল?
হাফিজ- না।
অন্তর-তুই যদি এখন এলাকাবাসীর কাছে ধরা পড়িস কি হবে একবার চিন্তা করছিস? তুই, তোর ফ্যামিলি এই বাসায় থাকতে পারবি? মিথিলা এলাকায় থাকতে পারবে ভাবছিস?
হাফিজ- আমি বেঁচে খাকতে না। আমি মিথিলাকে ভালবাসি।
অন্তর- এত ভয় পাচ্ছিস কেন! কত মেয়ে আসবে যাবে। আমি কি বলি শোন। এই যে এই গুলো মিথিলাকে যেভাবে পারিস এখন খাওয়াবি। এটা খাবার পর ওর আর কিছু মনে থাকবে না। কি এত ভাবিস? এটা ছাড়া রাস্তা থাকলে বল। আমি তোর কথাও চিন্তা করছি জন্য এইগুলা আনছি।
হাফিজ- আমি তোকে ভাল বন্ধু ভাবতাম।
অন্তর- অতকথা জানিনা তাড়াতাড়ি বল আমার সিগারেট শেষ।
হাফিজ অবাক হয়ে সামনের কুকুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন সে এই কুকুরটাকে বন্ধু হিসেবে ভাবত!
অন্তর আবার তাগাদা দিল। " মিথিলার কিছু মনে থাকবে নাতো বললাম, এত চিন্তা করিস কেন! দেখ তুই যদি আমার সোজা কথায় না রাজি হোস আমার বন্ধুদের ডাকবো। এতজনকে সহ্য করতে পারবে তো। চিন্তা কর।"
১৬.
অন্তর কিছুক্ষণ আগে মিথিলার ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।
হাফিজ রাস্তায় সোজা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে নোনা জলের ঢল নেমেছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। একটু যদি পেছনে ফেরা যেত। মাত্র চার ঘন্টা আগে যখন পাখিকে সে বাসায় আসতে বলেছিল, সেই চার ঘন্টা আগে ফিরে যেতে চায়। সে আর কোনদিন ঝগড়া করবে না, কোনদিন কষ্ট দেবে না, কোন দিন ভালবাসার প্রমাণ চাইবে না শুধু একবার পেছনে ফিরতে চায়। শুধু একবার। বুকের মাঝে হাহাকার করে ওঠে। পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন হয়!
বিকেলের রোদ আকাশে, সন্ধ্যে নামতে তখনও অনেক দেরি। একটা একটা করে জানালাগুলো বন্ধ করে অন্তর।
Comments
Post a Comment