ব্যাচেলরদের বিশেষ করে ঢাকার ব্যাচেলরদের একটা শৌখিনতা আছে। একটু ফাঁকা সময় পাওয়া গেল,একা বা দুটো বন্ধু জুটলোতো সোজা চায়ের দোকানে বসে সিগারেট টানতে টানতে চা খাওয়া (পান করা আরকি) শুরু। কেউ এটা প্রায়ই খায়, কেউ নেশার মত প্রতিদিন খায়।
এই টংএর দোকানে বসে চা খাবার মজাটা আমি এখনও ধরতে পারিনি। আমি এভাবে চা খুব কম খাই। একারণে আবার আমার আশেপাশে যারা "সেই রকম চাখোর" মানুষ তারা আমার সাথে থাকলে বিপদে পড়ে যায়। আমি তাদের চা খেতে বলি না, তারা চা খাবার কথা বললে "না খাবো না" বলে দেই। তখন তারা ভদ্রতা দেখাবে নাকি আমাকে দাঁড় করিয়ে একা একা চা খাবে তা নিয়ে মহা ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে।
এই ভ্যাবাচ্যাকার প্রথম শিকার সম্ভবত নিশান। নিশান ঢাকা থেকে আমার বাসায় (কুড়িগ্রামে) বেড়াতে এল। আমি তাকে নিয়ে এখানে ঘুরি, সেখানে ঘুরি। ঘুরতে ঘুরতে সকাল থেকে বিকাল হয়, এটা খাওয়া হয় সেটা খাওয়া হয় কিন্তু তাকে চা খাবার কথা বলি না বা চা খাবার কথা উঠলে কি দরকার বলে এড়িয়ে যাই। ছেলে পড়ল বিপদে। সে ঢাকায় যত আড্ডা দেয় সাথে চা থাকেই। তাদের অভ্যাস এটা। সারাদিন গেল অথচ গরম চায়ে এক চুমুকও দিতে পারে নি! অবশেষে সন্ধ্যার পর নিজেই জোর করে আমি সহ আমার বাকি বন্ধুদের নিয়ে চা খেতে ধরে নিয়ে গেল। তৃপ্তি করে চা খেতে পারে অবশেষে। চা খাওয়াটা ছিল দেখার মত। এত ভালবেসে চা খেতে কখনও কাউকে দেখিনি তার আগে।
অবশ্য সেই "চা খেতে" যাওয়াটাও আরেক বন্ধুর জন্য চিরকালের দূর্ভাগ্য বয়ে আনে। সেটা আমরা যতদিন বেঁচে আছি সে ভুলতে পারবে না, আমরাও তাকে ভুলতে দেবো না। বন্ধুটি হল নির্ঝর। চায়ের বিল দিতে নির্ঝরকে বললে সে বলে তার কাছে কোন টাকা নাই। তাকে গত তিন দিন থেকে বাসা থেকে একটাকাও দেয়নি। বড় কষ্টে আছে। বিশ্বাস না হলে চেক তাকে করে দেখতে পারি।
এর আগে কখনও আমরা বন্ধুরা টাকা নাই শুনে বডি চেক করিনি। কিন্তু সেদিন আরেক বন্ধু লিমন ফাজলামি করে নির্ঝরের পকেটে হাত দিতেই টাকা বেরিয়ে এল। তাও আবার খুচরো টুচরো মিলে দুইশ টাকার মত। নির্ঝর আর যায় কোথাও! সেদিনতো বিল দিলই এরপর সে যখনই বলে টাকা নাই আমরা তার দিকে ট্যারা চোখে তাকাই। তারপর সার্চ করে টাকা বের করি।
যাই হোক আসল কথায় আসি। এই যে চা খাবার শৌখিনতাটা আমি আজও বুঝিনি। পরীক্ষার জন্য পড়তে বসে পড়া কিসের কি এইসব চিন্তা আসছিল মাথায় যে মানুষ চা কত আদর করে খায়! টংএর দোকানে সিগারেট ফুকতে ফুকতে চা খাবার আনন্দ কেন আমি বুঝতে পারিনি এটা নিয়েও চিন্তা করলাম। কুল কিনারা না পেয়ে মনে হল সব বাদ দিয়ে প্রাকটিক্যালি চা খেযে আসি না! সরজমিনেই বের করব সমস্যা কোথায়।
নিচে নেমে দেখি বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। কাছাকাছি হেঁটে রাস্তার পাশের একটা দোকানে ঢুকলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছোট্ট দোকান। লাল চা দিতে বললাম।
চায়ের গুণাগুণ, ব্যাচেলরদের শৌখিনতা, সিগারেট না নিয়েও কিভাবে এর অভিজ্ঞতা বোঝা যেতে পারে, না পড়ে কিভাবে কাল ফাইনালে পাশ করব(!) চায়ে চুমুক দিতে দিতে এসব হাবিজাবি ভাবছি। ঠিক এমন সময় বৃষ্টি থেকে বাঁচতে স্কুলড্রেস পড়া ক্লাশ এইট নাইনের মেয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।
এবার সব বাদ মেয়েটাকে নিয়ে ভাবা শুরু করলাম। আহা সেকি মধুর ভাবনা!
বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কত নাটক সিনেমাতে এই বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ দেখা থেকেই কত কিছু হতে দেখেছি! সিঙ্গেল মন দিড়িম দিড়িম শুরু করল। আমি তাকে এক ঝলক দেখে অন্য দিকে তাকাই, সে আমাকে এক ঝলক দেখে আরেক দিকে তাকায়। দুজনে হঠাৎ এক সাথে তাকাই! এই বুঝি কিছু হয়! আমি আরেকটু কাছে গেলাম। কিছু কি বলা উচিৎ? কি বলে শুরু করা যায়!স্লো মোশন, স্লো মোশন পরিবেশ। পুরো দোকানটাতে শুধু আমি আর সে আর দোকানদার আর সাত জন মানুষ (ওহ্যা আন্টি টাইপ মহিলাও ছিল >.< )। দমকা হাওয়া বইছে। বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি শব্দ যেন বলছে আগা আবুল আগা।
আমি এগোতে যাবো ঠিক এমন সময় মেয়েটা চিৎকার দিয়ে বলা শুরু করল "ওই বৃষ্টি থাম, ওই বৃষ্টি থাম।"
আমি সহ দোকানের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে। এগোতে যেয়েও থমকে গেলাম। অল্পের জন্য পাগলের হাতে পড়ি নাই। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। বৃষ্টিকে থামতে বলে! হাজার খানেক তার ছিড়া!
এমন সময় দেখি একটা মেয়ে ছাতা নিয়ে এগিয়ে এল। আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা সেই ছাতার নিচে গিয়ে দুজনে গল্প করতে করতে আমার কাছ থেকে চলে গেল। বলতে গেলে সব ঘটল চোখের পলকে। আমি হতবাক। ঘটনার আকষ্মিকতা থেকে বের হলাম যখন দোকানদার ঝাড়ি দিল "ও মামা, কাপ দেন!"
পরে বুঝলাম ছাতা নিয়ে আসা মেয়েটার নাম বৃষ্টি। ওকেই থামতে বলেছিল মেয়েটা। অথচ বৃষ্টি থামল না। আমার চায়ের শৌখিনতা বিষয়ক গবেষণাকেও ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
Comments
Post a Comment